বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো ভারতের শিল্পগোষ্ঠী আদানি এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ। বহু আলোচনার পরও সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আদানি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই খবর শুধু দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক বিরোধ নয়, বরং বাংলাদেশের জ্বালানি খাত, অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, এবং তখন থেকেই অভিযোগ ওঠে এটি একটি অসম চুক্তি। এতে আদানিকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, অথচ বাংলাদেশের জন্য এটি আর্থিকভাবে ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানির ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর ধরে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে কেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করলে চুক্তির বাস্তবায়নও শুরু হয়। তখন থেকেই কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ তীব্র হতে থাকে।
বাংলাদেশ সব সময় অভিযোগ করেছে, আদানি আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরে কয়লা সরবরাহ করছে। কয়লার দাম নির্ধারণে সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইনডেক্স ও ইন্দোনেশিয়ার সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওই সূচকে উল্লিখিত দামের চেয়েও কম দামে বাজার থেকে কয়লা সংগ্রহ করা সম্ভব। যেমন বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বা চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে চীন ও এস আলম গ্রুপের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষ ছাড়ে কয়লা সংগ্রহ করছে। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ কম পড়ছে। কিন্তু আদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই ছাড় পাচ্ছে না। এর ফলে একই মানের কয়লা হলেও টনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলারের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।
এই পার্থক্যের কারণে বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। পিডিবির হিসাবে, আদানির কাছ থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের গড় খরচ হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১৪ টাকা ৮৭ পয়সা। অথচ ভারতের অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম গড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৪০ পয়সা। দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রেও উৎপাদন খরচ কম, যেমন পায়রায় খরচ হচ্ছে ১২ টাকার নিচে। মাতারবাড়ীতে চুক্তি হলে দাম ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। তুলনায় স্পষ্ট বোঝা যায়, আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ। এতে সরকারের ভর্তুকির চাপ বাড়ছে, সাধারণ জনগণকে বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
বিরোধের সূত্রপাত আরও আগে। বৈদেশিক মুদ্রাসংকট বাড়তে থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে আদানির বিল বকেয়া পড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে সেই বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭০ কোটি ডলার। যদিও পরে এর বড় অংশ পরিশোধ করা হয়, তবুও কয়লার বাড়তি দাম ধরে আদানির করা বিল অনুসারে এখনও প্রায় ২০ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয় পিডিবি ও আদানির মধ্যে, কিন্তু সমাধান আসেনি। আদানি কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। বরং তারা বলছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ীই তারা বিল করেছে, তাই সালিশি আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে তারা আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শক নিয়োগও দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী? বিদ্যুৎ বিভাগের উপদেষ্টা জানিয়েছেন, যদি আদানি সালিশি আদালতে যায় তবে বাংলাদেশকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে এবং শক্ত অবস্থান নিতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তিটি এতটাই অসম যে আদালতে গেলেও বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। কেননা, চুক্তিতে কয়েকটি শর্ত এমনভাবে রাখা হয়েছে যা আদানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ ধরা হয়েছে, যা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো অন্যান্য চুক্তিতে নেই। এছাড়া আদানির বিনিয়োগের বিপরীতে সব সুদের হার ভারত নির্ধারণ করবে, এমনকি পানি ব্যবহারের খরচও বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ ম তামিমসহ অনেকেই বলছেন, চুক্তিটি পুনঃআলোচনা করা ছাড়া বিকল্প নেই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যাই হোক, আলোচনার মাধ্যমে শর্ত পরিবর্তন করা গেলে বিদ্যুতের দাম কিছুটা হলেও কমে আসবে। যদি আদানি এতে রাজি না হয়, তবে আদালতে গিয়ে অসম চুক্তির বিষয়গুলো তুলে ধরা যেতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে লড়াই সহজ নয়, এতে সময় ও অর্থ দুটোই বেশি খরচ হয়। অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর মতে, সরকারের উচিত স্থানীয় আদালতে আদানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের মামলা করা। কারণ আগেও বিদেশি কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মামলা করে বাংলাদেশ জিতেছিল।
বড় প্রশ্ন হলো, আদানির সঙ্গে এমন চুক্তি করা হলো কেন? উত্তর খুঁজতে গেলে রাজনৈতিক বাস্তবতায় চোখ দিতে হয়। আদানি গোষ্ঠী ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিগুলো অনেকটাই রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে গিয়ে অনেক চুক্তিই বাংলাদেশের জন্য অস্বচ্ছ বা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে এসব চুক্তি পর্যালোচনার দাবি জোরালো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাক্ষরিত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাতিল করা সহজ নয়। তাই আলোচনার মাধ্যমে শর্ত সংশোধন করাই এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।
এ বিরোধ শুধু বিদ্যুৎ খাতের বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গেও সম্পর্কিত। দেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। তার ওপর যদি অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ কিনতে হয়, তাহলে চাপ আরও বাড়বে। জনগণকে বিদ্যুতের বেশি দাম দিতে হবে, শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি চাপে পড়বে। বিদ্যুৎ খাতের এই সংকট দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ বিদ্যুতের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়বে, আর তা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছে। পায়রা, বাঁশখালী, রামপালসহ একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নেপাল ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সমস্যা হলো, অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও সেগুলো চালাতে প্রয়োজনীয় কয়লা বা গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে একদিকে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকছেই। এর মধ্যে আবার উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে, যা অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক।
আদানির সঙ্গে চুক্তি তাই কেবল বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি রাজনৈতিক সম্পর্কেরও প্রতিফলন। কিন্তু এখন যখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারা একদিকে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে, অন্যদিকে জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপও দিতে পারবে না। তাই তাদের কৌশল হতে পারে আলোচনার মাধ্যমে আদানিকে কিছুটা ছাড় দিতে রাজি করানো, অথবা আদালতে গিয়ে চুক্তির ত্রুটিগুলো সামনে আনা।
এখন যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার আগে সেগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি। রাজনৈতিক সুবিধা বা কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে যদি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর চুক্তি করা হয়, তবে তার মূল্য বহন করতে হয় বছরের পর বছর। আদানির সঙ্গে বিরোধ প্রমাণ করেছে, একটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা নাজুক হয়ে উঠতে পারে যখন নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা থাকে না।
ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা নেওয়া। বাংলাদেশের উচিত বিদ্যুৎ খাতে বৈচিত্র্য আনা—শুধু কয়লাভিত্তিক নয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহার করা এবং আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। পাশাপাশি প্রতিটি চুক্তি স্বচ্ছতার সঙ্গে করা, জনসমক্ষে আনা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া জরুরি। নাহলে আদানির মতো পরিস্থিতি বারবার তৈরি হবে, যা অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটোই অস্থিতিশীল করবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আদানির সঙ্গে কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের গভীর সংকটকে সামনে এনেছে। এটি কেবল একটি চুক্তির সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘদিনের ভুল নীতি, রাজনৈতিক চাপ এবং স্বচ্ছতার অভাবের ফল। এখন যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ খাত আরও বড় সমস্যায় পড়বে, আর তার বোঝা বহন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। আদানির মামলা বা সালিশ যেভাবেই গড়াক, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আপনার মতামত জানানঃ