
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও উত্তেজনা ও প্রস্তুতির সময় এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে দেশ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের প্রশাসনিক, আইনশৃঙ্খলা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়, সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “এটি হবে একটি চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন। যত বাধা আসুক না কেন, আমরা গণতন্ত্রের এই পথ থেকে পিছিয়ে যাব না।”
আগামী ১লা নভেম্বর থেকে শুরু হবে নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক পদায়ন। প্রেস সচিব জানান, জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টনের জন্য ইতিমধ্যেই ৬৪ জেলার তালিকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা রক্ষায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কোনো কর্মকর্তা নিজ জেলার শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এছাড়া গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার বা পোলিং এজেন্টের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের এবারে রাখা হবে না।
এ পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে—আগের যেকোনো বিতর্ক বা পক্ষপাতের অভিযোগ থেকে নির্বাচনী প্রশাসনকে মুক্ত রাখা। অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা, নতুন মুখ ও নতুন কাঠামোই নিরপেক্ষতার বার্তা দেবে ভোটারদের। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সরকার একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে চায়, যেখানে প্রশাসন হবে পুরোপুরি পেশাদার ও পক্ষপাতমুক্ত।
প্রেস সচিব আরও বলেন, “নির্বাচন ঘিরে ভেতরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্র হতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে গুজব, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।” এই বিষয়ে সরকার ইতিমধ্যেই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে এবং প্রধান উপদেষ্টা নিজেই সতর্কতা জারি করেছেন।
তিনি জানান, মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ঠেকাতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ করবে এবং মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত প্রভাবমূলক প্রচারও নজরদারির আওতায় থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সম্ভাব্য সাইবার আক্রমণ ও গুজবের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষায়, “নির্বাচন বানচাল করতে দেশের ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকেও কিছু শক্তি সক্রিয় হতে পারে। তারা বড় শক্তি নিয়ে আসবে, নানা পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত।”
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টায় কেউ সফল হবে না। যত ঝড়-ঝাপ্টাই আসুক, আমাদের সেটি অতিক্রম করতে হবে।” তাঁর মতে, দেশের জনগণ এখন শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের অপেক্ষায়, এবং সরকারের দায়িত্ব হলো তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করা।
দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিশেষ নজরদারি থাকবে যাতে কোনোভাবে অস্ত্র বা অবৈধ অর্থ নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার না হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বাড়তি গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়েছে।
এছাড়া ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হবে। নির্বাচন কমিশন চাইলে ভোটের আগে বা ভোটের দিন সেনা মোতায়েন করা হতে পারে। লক্ষ্য একটাই—প্রতিটি ভোটার যেন ভয়ভীতিমুক্তভাবে ভোট দিতে পারেন।
প্রেস সচিবের ভাষায়, “নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, জনগণের নিরাপত্তার বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। জনগণ যাতে গণতন্ত্রের উৎসব উপভোগ করতে পারে, সেটাই প্রধান লক্ষ্য।”
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী সময়সীমায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণের জন্যও প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার চায়, বিশ্বের কাছে এই নির্বাচন হোক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার উদাহরণ।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও নির্বাচনটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক আস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করছে অন্তর্বর্তী প্রশাসন। এ কারণে নির্বাচনী ব্যয়, নিরাপত্তা তহবিল ও পর্যবেক্ষণ ব্যয়ের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়—এটি একটি আস্থার প্রক্রিয়া। সেই আস্থা পুনর্গঠনের পথেই তিনি এগোচ্ছেন। তাঁর কথায়, “আমরা এমন একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, যা শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়, জনগণের আস্থার পুনর্জন্ম ঘটাবে।”
তিনি আরও বলেন, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। যে কোনো মূল্যে দলীয় আধিপত্য, অর্থবিত্তের প্রভাব ও প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব থেকে নির্বাচনকে মুক্ত রাখতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নির্বাচনী প্রচার থাকবে কঠোর নিয়ন্ত্রণে। কোনো প্রার্থী বা দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (টুইটার) এবং টিকটকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ছড়ানো হলে তা শনাক্ত করে সরিয়ে দেওয়া হবে।
দেশজুড়ে এখন প্রশাসন থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতির আমেজ। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাচন অফিসারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করছে।
নির্বাচনের দিন যেন কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা না ঘটে, সে জন্য কেন্দ্রভিত্তিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। শহরাঞ্চলের সব ভোটকেন্দ্র অনলাইনে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ অনেকের কাছে নতুন আশা জাগাচ্ছে, আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন বাস্তবায়নের সামর্থ্য নিয়ে। বিশ্লেষকদের মতে, সব কিছু নির্ভর করবে সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতির ওপর। দেশের ইতিহাসে এমন নির্বাচন খুব কমই দেখা গেছে, যেখানে পুরোনো প্রশাসনিক কাঠামো সম্পূর্ণ বদলে নতুন করে শুরু হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচন সবসময়ই উত্তপ্ত অধ্যায়। কিন্তু এবার সরকার বলছে, তারা চাইছে ভোট হোক উৎসবমুখর, নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য। নির্বাচন যত চ্যালেঞ্জিংই হোক, দেশের গণতন্ত্রকে নতুন পথে এগিয়ে নেওয়ার এটাই সুযোগ।
এখন পুরো জাতির চোখ নির্বাচনের দিকে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে ভোটযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক কাউন্টডাউন। এই নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, বরং দেশের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের এক বড় পরীক্ষায় পরিণত হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের ভাষায়, “এটি বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়ের সময়—যেখানে জনগণই হবে প্রকৃত শক্তির উৎস।”
আপনার মতামত জানানঃ