ভারতের লাদাখ আজ আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলটিতে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনের মাধ্যমে ২০১৯ সালে লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় জনগণ শুরু থেকেই এই সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিল। তাদের দাবি, লাদাখকে শুধু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দিলেই হবে না; পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর ফলে এখানকার আঞ্চলিক স্বার্থ, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও স্থানীয় জনগণের অধিকার সুরক্ষিত হবে। গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চললেও সাম্প্রতিক সময়ে তা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, যা গোটা ভারতে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
২৪ সেপ্টেম্বর লেহ শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবিগুলো তুলে ধরলেও পরবর্তীতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা বিজেপির পার্টি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একটি পুলিশের গাড়িও পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ৭০ জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে।
লাদাখের সুপরিচিত পরিবেশ আন্দোলনকারী ও শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক এ ঘটনায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসতায় পরিণত হওয়া দুঃখজনক এবং এটি তরুণদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ওয়াংচুক বহুদিন ধরেই লাদাখের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার দাবি জানিয়ে আসছেন। তার মতে, স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে এবং তরুণ প্রজন্মকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি এটিকে “দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা আগুনের বিস্ফোরণ” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
লাদাখের জনগণের দাবি মূলত চারটি বিষয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমত, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া। এর ফলে এখানকার উপজাতি সম্প্রদায় ও স্থানীয় সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সাংবিধানিক নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, লাদাখের জন্য পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা। বর্তমানে লাদাখের তরুণরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তৃতীয়ত, লেহ ও কার্গিল জেলার জন্য পৃথক পৃথক লোকসভা আসন নিশ্চিত করা। বর্তমানে লাদাখের মাত্র একটি আসন রয়েছে, যা পুরো অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। চতুর্থত, স্থানীয়দের জন্য ভূমি ও কর্মসংস্থান সংরক্ষণের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করা।
বুধবারের আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল লেহ অ্যাপেক্স বডির যুব শাখা। তাদের চেয়ারম্যান থুপস্তান সোয়াং বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালানো সত্ত্বেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। তিনি নিহতদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না বলে ঘোষণা দেন এবং আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ইঙ্গিত দেন। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকার বছরের পর বছর ধরে তাদের দাবি উপেক্ষা করে আসছে। যদিও আগামী ৬ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে লাদাখের প্রতিনিধিদলের বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে, তার আগেই সহিংসতার ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
এই ঘটনার পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের মাধ্যমে অঞ্চলটির বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে কেন্দ্রীয় সরকার। তখন জম্মু-কাশ্মীরকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও লাদাখকে আরেকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে আলাদা করা হয়। কিন্তু তখন থেকেই লাদাখের মানুষ আশঙ্কা করতে থাকে যে, তাদের ভূমি, সংস্কৃতি ও পরিচয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো তাদের জন্য আলাদা আইনসভা রাখা হয়নি। ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
লাদাখ একটি ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। একদিকে চীনের সীমান্ত, অন্যদিকে পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশী পরাশক্তির সন্নিকটে এই অঞ্চল ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাদাখে ভারত-চীন সীমান্তে একাধিকবার উত্তেজনা দেখা গেছে। সেই প্রেক্ষাপটে লাদাখের জনগণের অসন্তোষ দমন নয়, বরং সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা ভারতের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা মনে করে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বদলে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হবে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ফিরে পাবে।
এছাড়া পরিবেশগত দিক থেকেও লাদাখ অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা। হিমালয় অঞ্চলের এই এলাকাটি জলবায়ু পরিবর্তন ও অতি মাত্রার উন্নয়নচাপের কারণে বিপদের মুখে। সোনম ওয়াংচুকসহ বহু পরিবেশবিদ মনে করেন, স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই লাদাখের জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
লাদাখের এই আন্দোলন শুধু স্থানীয় জনগণের দাবির বিষয় নয়, বরং এটি ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যতেরও একটি পরীক্ষা। কেন্দ্রীয় সরকার যদি তাদের দাবি উপেক্ষা করে, তবে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হতে পারে এবং সহিংসতার মাত্রাও বাড়তে পারে। অন্যদিকে, যদি আলোচনার মাধ্যমে দাবি মেনে নেয়া হয়, তবে এটি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কারফিউ জারির মধ্যেও বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নিহতদের মৃত্যুতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে। লাদাখের তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতের আন্দোলনের জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সব মিলিয়ে লাদাখের বিক্ষোভ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার একদিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণ তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই দ্বন্দ্ব কীভাবে সমাধান হয়, তা নির্ভর করবে আগামী মাসগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর। লাদাখের মানুষ বহুদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানিয়ে এসেছে, কিন্তু যখন সেই দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, তখন সহিংসতা জন্ম নিয়েছে। তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সমাধান, যা স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করবে এবং একইসাথে ভারতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকেও নিশ্চিত করবে।
আপনার মতামত জানানঃ