বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে ব্রিটিশ জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান প্যালাটাইন মিডিয়ার কর্মকাণ্ড। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যদের কাছে ভুয়া সাংবাদিকদের নামে ব্লগ পোস্ট ছড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর-এর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ তুলেছিল। পুরো বিষয়টি সমন্বিত এক smear campaign বা কুৎসা রটনার অপচেষ্টা হিসেবে ধরা পড়লেও পরে জানা যায়, একই প্রতিষ্ঠান কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সরাসরি আওয়ামী লীগের জন্য কাজ শুরু করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—কোন স্বার্থে একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে টার্গেট করা হলো, আর কেনই বা বিদেশি লবিং ও জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে?
ঘটনার সূচনা হয় যখন লন্ডনে ব্রিটিশ সংসদে ড. আহসান এইচ মনসুরের নির্ধারিত বৈঠকের আগে প্যালাটাইন মিডিয়া সংসদ সদস্যদের কাছে ইমেইলে কিছু প্রবন্ধ পাঠায়। সেই প্রবন্ধগুলোতে মিথ্যা নাম ব্যবহার করে লেখা হয় যে গভর্নরের কন্যার নামে “অজানা” সম্পদ রয়েছে এবং সেটির সঙ্গে তিনি জড়িত থাকতে পারেন। অভিযোগগুলো প্রমাণহীন ও ভিত্তিহীন ছিল, তবে এগুলো ছড়ানোর সময় এমনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে ড. মনসুরের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দুর্বল হয়। পরে যুক্তরাজ্যের অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ অন রেসপনসিবল ট্যাক্স অ্যান্ড করাপশন বিষয়টি তদন্তের জন্য উত্থাপন করে এবং গণমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
তবে আসল ধাক্কা আসে যখন প্রমাণ পাওয়া যায় যে একই প্রতিষ্ঠান প্যালাটাইন মিডিয়া আওয়ামী লীগের জন্য জনসংযোগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কনাল ওয়ালশ এক ইমেইলে সরাসরি জানিয়ে দেন যে তিনি শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারসহ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রশ্নোত্তর দিয়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেন, মনসুরবিরোধী প্রচারণা চালানোর সময় তাঁরা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেননি। কিন্তু দুই পক্ষের স্বার্থ কোথাও গিয়ে মিলে গেছে—এমন ধারণা এখন প্রবল হচ্ছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নন, বরং একজন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে তিনি অর্থপাচার ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে ব্রিটেনে অবস্থিত সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার পরই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার জোরদার হয়। বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হয়তো আশঙ্কা করছিলেন, মনসুরের নেতৃত্বাধীন তদন্তে তাঁদের অবৈধ সম্পদ জব্দ হতে পারে। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় তাঁকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “এটি নিছক একটি smear campaign ছাড়া আর কিছু নয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রক্রিয়াটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে আঘাত করা, যাতে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও সম্পদ উদ্ধারের কাজ দুর্বল হয়ে পড়ে।” তাঁর মতে, এমনও হতে পারে যে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো আন্তর্জাতিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দিক থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ বহু বছর ক্ষমতায় থাকার পর বর্তমানে বিচারিক ও রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে তারা অভিযুক্ত। ক্ষমতা হারানোর পর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিদেশে লবিং কার্যক্রম চালাচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সজীব ওয়াজেদ জয় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ এক লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। ব্রিটেনে আবার প্যালাটাইন মিডিয়ার মতো জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ভাড়া করা হয়েছে। পাশাপাশি ডোটি স্ট্রিট চেম্বার্স নামে একটি আইনজীবী প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করা হয়েছে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করার জন্য।
তবে এসব কার্যক্রমের অর্থ কোথা থেকে আসছে, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। প্যালাটাইন মিডিয়া স্পষ্ট করে জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে কে তাদের অর্থায়ন করছে। যুক্তরাজ্যের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পাবলিক রিলেশনসের আচরণবিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ক্লায়েন্টের নাম প্রকাশ করা, কিন্তু প্যালাটাইন বলছে তারা কোনো লবিস্ট নয়, বরং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এভাবে তারা নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবে ইমেইল পাঠানো, ব্লগ বিতরণ করা কিংবা সংসদ সদস্যদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা সরাসরি লবিংয়ের মধ্যেই পড়ে। ব্রিটিশ আইনেও এটিকে লবিং হিসেবে গণ্য করা হয়।
এখানে মূল প্রশ্ন হলো—একটি রাজনৈতিক দল যখন আন্তর্জাতিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চায়, তখন তারা কি আসলে জনগণের কাছে জবাবদিহি থেকে সরে যাচ্ছে না? কারণ দেশের ভেতরে সমর্থন হারালেও বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। অথচ সেই টাকার উৎস নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই।
এদিকে ড. আহসান এইচ মনসুরকে ঘিরে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও উদ্বেগজনক। একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নষ্ট হলে দেশের ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও সংকোচ বোধ করতে পারেন। ফলে এটি শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো অর্থনীতিকেই আঘাত করার সমান।
এই ঘটনাকে ঘিরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সামনে এসেছে—রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা ব্যবসায়ীরা কীভাবে বিদেশি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে নিজেরা রক্ষা পেতে চাইছে। অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে যখন কঠোর অভিযান শুরু হয়, তখনই তাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে smear campaign শুরু হয়। তাই এই প্রক্রিয়া শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতিকেও কলুষিত করছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা সংগঠনগুলো বলছে, যুক্তরাজ্যের আইন ও নিয়মকানুনেও বড় ধরনের ফাঁকফোকর রয়েছে। PR প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যত কোনো জবাবদিহির মধ্যে রাখা হয়নি। ফলে বিদেশি রাজনৈতিক দলগুলো সহজেই এসব প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে পারছে। একদিকে স্বচ্ছতার অভাব, অন্যদিকে বাংলাদেশি গোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা—এই দুইয়ের মেলবন্ধনই প্যালাটাইন মিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে সহজ করেছে।
সবশেষে বলা যায়, ড. আহসান এইচ মনসুরকে টার্গেট করার মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া ও অর্থপাচারবিরোধী পদক্ষেপকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে একদিকে ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে পুরো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিদেশি লবিং প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ঘটনাটি তাদের রাজনৈতিক সংকট ও জনআস্থার ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এড়িয়ে গিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নেওয়া আসলে গণতন্ত্রের জন্যও নেতিবাচক বার্তা বহন করে।
বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়ের কাছেই এখন প্রশ্ন—একটি দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কি জাতীয় অর্থনীতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাকে বলি দেওয়া হবে? নাকি জবাবদিহির কাঠামো তৈরি করে এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে?
আপনার মতামত জানানঃ