বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালকে অনেকে উন্নয়ন, আবার অনেকে স্বৈরতন্ত্রের সময় হিসেবে দেখেন। কিন্তু একটি বিষয় সব মহলে প্রায় অভিন্নভাবে আলোচিত—তা হলো ব্যাপক দুর্নীতি এবং বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ। এই অভিযোগ শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যুক্তরাজ্যের মতো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোচিত হচ্ছে।
প্রকাশিত তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে কীভাবে কেবল অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। সংখ্যাটি শুধু বিশাল নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক।
২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতন শুরু হয়। কোটা সংস্কারের নামে সরকারি চাকরিতে দলীয় সুবিধাভোগী তৈরি করার চেষ্টা জনগণের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে। আন্দোলনের মূলে শুধু কোটা নয়—বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা বঞ্চনা, গুম-খুন, স্বৈরতন্ত্র ও সর্বোপরি দুর্নীতির অভিযোগ।
মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল যে দেশের সম্পদ ধীরে ধীরে বিদেশে পাচার হচ্ছে। জনসাধারণের জীবনে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও বৈষম্য বাড়লেও, ক্ষমতাসীনদের জীবনযাত্রায় আভিজাত্যের ছাপ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছিল।
তথ্যচিত্রে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি প্রবাসীদের দীর্ঘ ঐতিহাসিক উপস্থিতি রয়েছে। এই সম্পর্কই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য যুক্তরাজ্যকে অর্থ পাচারের এক জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত করেছে।
তদন্তে উঠে এসেছে শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত সম্পত্তির নথি। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক—যিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন—তিনি অল্প বয়সেই লন্ডনের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক হন, যা একজন বিতর্কিত ডেভেলপারের মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়েছিল।
শুধু শেখ পরিবার নয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামও আলোচনায় আসে। তাঁর মালিকানায় যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তি চিহ্নিত হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলেছে, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি ইতোমধ্যেই ৩৫০টির বেশি সম্পত্তি জব্দ করেছে, যার অনেকগুলোই বাংলাদেশি মালিকানার সঙ্গে যুক্ত।
এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—যেখানে বছরে একজন সাধারণ নাগরিক সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার বিদেশে নিতে পারে, সেখানে একজন মন্ত্রী কীভাবে শত শত সম্পত্তির মালিক হন?
তথ্যচিত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে ব্যাংক খাত থেকে। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি আবদুল মান্নানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলা হয়, তাঁকে ডিজিএফআই সদর দপ্তরে ডেকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপর ব্যাংকের বোর্ড নতুন করে সাজানো হয় এবং সেই বোর্ড ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠদের কাছে অগণিত জাল ঋণ বিতরণ করে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, ব্যাংক ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে অন্তত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বিশেষভাবে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
অর্থ পাচারের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং ছিল প্রধান পদ্ধতি। এ ছাড়া হুন্ডি বা হাওলা চক্র ছিল বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। বৈধ ও অবৈধ উভয় চ্যানেল ব্যবহার করে এই বিপুল অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রকাশ্যেই চলছিল। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত সব প্রকল্পেই দুর্নীতির গুঞ্জন ছিল। কিন্তু গুম-খুন, ভীতি ও আতঙ্কের কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। সবাই জানত দুর্নীতির কথা, কিন্তু চুপ থাকতে হতো।
শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথমেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠন, ব্যর্থ ব্যাংকগুলোতে তারল্য যোগান এবং সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্স গঠন ছিল তাঁর প্রধান পদক্ষেপ। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, ১১টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া অবস্থায় ছিল, যেগুলোকে সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না।
ড. ইউনূস বলেছেন, “আমরা আরেকটি ফ্যাসিবাদী শাসন চাই না।” এজন্য দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। তবে একই সঙ্গে তিনি নির্বাচন আয়োজনের চাপের মুখে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনও চাইছে বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে।
অর্থ ফিরিয়ে আনা কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ যারা টাকা পাচার করেছে, তারা বিশ্বমানের আইনজীবী ও অর্থ বিশেষজ্ঞ ভাড়া করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সমঝোতার ভিত্তিতে টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশি জনগণ এমন সমঝোতা মেনে নেবে কি না।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন অনেকের কাছে এক বিপ্লব মনে হলেও আশঙ্কা রয়েছে, আবার কোনো এক রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়তে পারে। এবার হয়তো তা আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি হবে। তবু ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা তরুণ প্রজন্মের দাবি স্পষ্ট—তারা আর দুর্নীতিবাজ শাসন মানতে রাজি নয়।
বাংলাদেশের হারানো বিলিয়নের গল্প শুধু একটি সরকারের নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিফলন। জনগণ রাস্তায় নেমেছিল স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে। এই আন্দোলন, তদন্ত ও তথ্যচিত্র একসঙ্গে দেখিয়ে দিচ্ছে যে দুর্নীতি রুখতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও জিম্মি হয়ে থাকবে।
আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—হারানো অর্থ কতটা ফেরত আনা সম্ভব এবং ভবিষ্যতের সরকারগুলো কতটা স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারবে।
আপনার মতামত জানানঃ