বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা একটি দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি, যা প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে। ১৯৮১ সালের ১৭ই মে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই পদে আছেন। কিন্তু দলীয় নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুব একটা মুখ খোলেননি। নেতৃত্বের প্রশ্নে এই নীরবতা দলের ভেতরে শূন্যতা তৈরি করেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক দিক থেকে হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, যার একটি বড় কারণই ছিল সুস্পষ্ট উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অভাব।
বর্তমানে শেখ হাসিনা ভারতের মাটিতে অবস্থান করছেন ‘অতিথি’ হিসেবে। তার রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং দলের সাথে যোগাযোগের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ধীরে ধীরে নিজের পরিবারের ওপর দলের দায়িত্ব অর্পণ করছেন। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নির্দিষ্ট ভূমিকা দিয়ে সামনে আনার পরিকল্পনা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও এই প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখবেন।
এখানে ভারতের কংগ্রেস দলের রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মডেলটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। সোনিয়া গান্ধীর শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার ছেলে-মেয়ে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন। শেখ হাসিনাও অনুরূপভাবে নিজের সন্তানদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নিয়ে আসছেন।
সায়মা ওয়াজেদ কিছুদিন আগেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে ছিলেন। কিন্তু তাকে হঠাৎ করে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগ এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। ফলে তার আন্তর্জাতিক কর্মজীবন থেমে গিয়ে তিনি মায়ের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সায়মা তার বক্তৃতা প্রস্তুত করা, ক্যালেন্ডার সাজানো, দর্শনার্থীদের সাথে বৈঠক আয়োজন—এসব দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
অন্যদিকে, সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও দলের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। তিনি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগের বক্তব্য প্রচার করছেন। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন এক প্রকার ‘ত্রিভুজাকার কাঠামো’তে গড়ে উঠেছে—দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ, ভার্জিনিয়ায় সজীব ওয়াজেদ, আর কলকাতায় দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের উপস্থিতি।
কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত উপেক্ষিত। প্রায় দশ মাস ধরে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। বরং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকের ওপর বেশি আস্থা রাখা হচ্ছে। সায়মা ওয়াজেদ নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, আর জয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি গড়ার কাজে।
দলের ভেতরে এই ‘সাকসেসন প্ল্যান’ নিয়ে এখনও প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন যে, শেখ হাসিনা আসলে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলকেই অনুসরণ করছেন। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত দাবি করেছেন, এখন দলের একমাত্র লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, পদ-পদবি নিয়ে ভাববার সময় নয়।
আসলে আওয়ামী লীগ একটি পরিবারকেন্দ্রিক দল। ভারতের কংগ্রেস যেমন গান্ধী পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত, তেমনি আওয়ামী লীগও ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’র নেতৃত্বে অভ্যস্ত। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরেই গান্ধী পরিবারের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। সোনিয়া গান্ধী, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। এমনকি তিনি রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ফলে তাদের রাজনৈতিক ধারা থেকে প্রেরণা নেওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
বয়েসের কারণেও শেখ হাসিনার সামনে সময়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চলতি মাসেই তিনি ৭৮ বছরে পা দেবেন। তাই উত্তরাধিকার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চাপও বাড়ছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকার দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রেখেছে, নেতৃত্ব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, আর দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি তীব্র হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার সন্তানরা দলের ভবিষ্যৎ হিসেবে উঠে আসছেন। সজীব ওয়াজেদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছেন, আর সায়মা ওয়াজেদ দলের ভেতরে সাংগঠনিক কাজ সামলাচ্ছেন। এভাবে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
এই পুরো প্রক্রিয়া বাংলাদেশে রাজনীতির ভবিষ্যতের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির সমালোচনা থাকলেও আওয়ামী লীগের জন্য এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচন। কারণ, দলটির গঠন ও ইতিহাসই পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এখন দেখার বিষয়, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ কতটা কার্যকরভাবে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেন, এবং তাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতের সংকটগুলো কতটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ