বাংলাভাষী মুসলিমদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার ঘটনা আজ নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্য রাজ্যে যেভাবে অভিযানের নামে সাধারণ শ্রমজীবী মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে, তা নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। এই নির্মম প্রক্রিয়ার একটি জীবন্ত দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি মেহেবুব শেখের কাহিনী।
মেহেবুব শেখ ছোটবেলায় ভাই মজিবুরের সঙ্গে গরু চরিয়ে দিন কাটাতেন। পরবর্তী সময়ে মুম্বই গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। দশ বছরের বেশি সময় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পর জুন মাসে হঠাৎই তিনি বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। ৯ জুন মুম্বইয়ের মীরা রোডে এক চায়ের দোকানে বসা অবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। অথচ তার কাছে আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড ছিল, যা তার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ। কিন্তু পুলিশ কোনো গুরুত্ব দেয়নি, বরং পরিচয়পত্রগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
মেহেবুব যতই বলছিলেন যে তিনি ভারতীয়, তার পূর্বপুরুষদের কবর মুর্শিদাবাদেই, পুলিশ কোনো কর্ণপাত করেনি। কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য যে সময়সীমা আইনত দিতে হয়, সেই সুযোগও তাকে দেয়া হয়নি। এমনকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য ৩০ দিন সময় দেয়ার নিয়ম থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ হয়নি। পরবর্তীতে বিএসএফ বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেয়।
মেহেবুবের পরিবার মরিয়া হয়ে নানা প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকে। তারা খুঁজে পায় প্র-পিতামহ সুলতান শেখের জমির দলিল এবং ১৯৫০-এর দশকের ভোটার তালিকা, যাতে দাদা জামসেদ শেখের নাম ছিল। গ্রামে পুরনো বাড়ি ও কবরস্থানও এখনো রয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান এসব নথির ভিত্তিতে দ্রুত মেহেবুবের ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করেন এবং বিএসএফ ক্যাম্পে যান। কিন্তু বিএসএফ কিছুই শুনতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিএসএফ ও বিজিবির বৈঠকের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ফেরানো সম্ভব হয়।
তবু এই ফেরত আসা মেহেবুবের জীবনে শান্তি আনেনি। তিনি আর মুম্বই ফিরতে চান না। তার পরিবারও বলছে পশ্চিমবঙ্গেই কাজ খুঁজতে। মুম্বইয়ে যেখানে দিনে এক হাজার রুপি পেতেন, এখন পান মাত্র সাতশো। পরিচিত শ্রমিক পাঠানোর কমিশনও হারিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো আত্মমর্যাদার। দীর্ঘদিনের গর্বের কাজ ও পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
গ্রামে তার ফেরার পর পরিবার কিছুটা স্বস্তি পেলেও ভয় আবার জেগে উঠেছে। কারণ, ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি হালনাগাদে ১৯ লাখ মানুষ বাদ পড়েছিলেন। মানুষ আশঙ্কা করছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু হতে পারে। মেহেবুবের স্ত্রী সুরোনা বিবি চান না তিনি আর বাইরে কাজে যাক। তার ভয়, আবারও নাগরিকত্ব নিয়ে ঝামেলায় পড়বেন। কিন্তু মেহেবুবের কষ্ট হলো, তিনি কোনো অপরাধ না করেও কেন এই শাস্তি ভোগ করবেন।
এই ঘটনাটি কেবল মেহেবুবের নয়। পশ্চিমবঙ্গসহ বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার মুসলিম শ্রমিককে বিদেশি হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জন্মসনদ ও অন্যান্য বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তা অস্বীকার করছে। রাজনৈতিক স্বার্থে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে, ন্যায্য শুনানির সুযোগও দেয়া হচ্ছে না। নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং মানবিক সংকট একসাথে তৈরি হচ্ছে।
মেহেবুব শেখের হোয়াটসঅ্যাপ ডিসপ্লে পিকচারে এখনো সেই সুউচ্চ ভবনের ছবি আছে, যেখানে তিনি শেষবার কাজ করেছিলেন। আজ তিনি মুর্শিদাবাদের গ্রামে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন, “আমি কোনো অপরাধ করিনি, তবে কেন এই শাস্তি?” এই প্রশ্ন কেবল তার নয়, বরং হাজারো বাংলাভাষী মুসলিম শ্রমিকের প্রশ্ন। তারা কেবল একটি নিরাপদ জীবনের অধিকার চান। নাগরিকত্বের নামে তাদের আত্মমর্যাদা কেড়ে নেয়া যাবে না—এই বার্তাই আজ সবার সামনে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
আপনার মতামত জানানঃ