পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব এখন চরম সংকটাপন্ন ও ক্রান্তির অবস্থানে দাঁড়ানো। পাহাড়ের প্রকৃতিও এখন বেশ হতাশ। যাপিত বাস্তবতার উপত্যকায় দাঁড়ানো পাহাড়ের জীববৈচিত্রতার আর্তচিৎকার। প্রকট থেকে অধিকতর প্রকটভাবে ধ্বনিত পাহাড়ের ক্রন্দন। সবমিলিয়ে পাহাড় কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা এবং পাহাড়ের সহজ সরল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব বর্তমানে ব্যাপক হুমকির মূখে পতিত। একসময় পাহাড় অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির অনুকূলে বেশ সবুজ ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই। সবুজ পাহাড়কে বিবর্ণ করা হয়েছে। চরম বিবর্ণ!!! যে বিবর্ণের হিংস্র ছাঁয়াই পাহাড়কে তিলে তিলে মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে পর্যবসিত হতে হচ্ছে। পাহাড়ের ভূমিপুত্র আদিবাসীরা একসময় তাদের জন্মভূমি পাহাড়ের বুকে প্রাণভরে উচ্ছাসিত নিশ্বাস নিতে পারতো, এখন আর সেটা পারেনা। সম্ভবও না। তাদের এখন স্বস্তির নিশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। দিনশেষে তারা তাদের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার শ্বাসকষ্টে ভোগে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে রাষ্ট্রের কাছে আদিবাসীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের অস্তিত্ব মৌলিকভাবে সংরক্ষনের দাবি করে আসছিলো। কিন্তু রাষ্ট্র আদিবাসীদের দাবিকে কর্ণপাত করেনি, আমলে নেয়নি। নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন। এবং স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু একনায়তন্ত্র ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাষায় বলেছিলেন ‘জাতি উপজাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশে আমরা সবাই বাঙালী’! বঙ্গবন্ধুর এহেন প্রতক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী আদিবাসীদের মনে সন্তুষ্টির বাসা বাঁধতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আদিবাসীরা বিশ্বাস এবং আস্তার পদক্ষেপ দেখেনি। অথচ উনি এখন আমাদের বাংলাদেশের বাঙালী জাতির পিতা! সেদিনই বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের অস্তিত্বকে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে গেছেন। আদিবাসীদের জাতিগত পরিচয় হতে হবে বাঙালী, যা আদিবাসীরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি এবং আগামীতেও পারবে না। কারণ একজন বাঙালী কখনো আদিবাসী জাতির পরিচয়ে বাঁচতে পারেনা, তদ্রুপ একজন আদিবাসীও কখনো বাঙালী পরিচয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রাখেনা। এটা নিয়ে আদিবাসীদের প্রাণপ্রিয় নেতা “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা”(এমএন লারমা) গণপরিষদের অধিবেশনে প্রতিবাদও করেছিলেন। সেসময়ে এমএন লারমা গণপরিষদের সাংসদ ছিলেন। এবং এমএন লারমার প্রতিবাদ ও দাবি আমলে না নেয়ার কারণে গণপরিষদ অধিবেশন থেকে এমএন লারমা ওয়াক আউট করে বেড়িয়ে এসেছিলেন।
আদিবাসী নেতা এমএন লারমা ছিলেন বিশ্বের সকল সর্বহারা, গরীব দুঃখী, অধিকার বঞ্চিত মেহনতি মানুষের পক্ষে। তার বজ্রকন্ঠ সর্বদা সোচ্চার ছিলো অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
আদিবাসী নেতা এমএন লারমা -এই মহান মানুষটি কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে শুরু হয় কাপ্তাই বাঁধের কাজ এবং শেষ হয় ১৯৬২ সালে। এই কাপ্তাই বাঁধের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৩৬৯টি মৌজার মধ্যে ১২৫টির প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট ১ লক্ষ আদিবাসী উদ্ভাস্ত হয়। উদ্ভাস্ত হওয়া ১৮ হাজার পরিবারগুলোর মধ্য ১০ হাজার পরিবার কর্নফুলী, চেংগী, কাচলং এবং কয়েক নদীর অববাহিকায় চাষী ছিলেন এবং বাকী ৮ হাজার পরিবার ছিলেন জুম চাষী। কর্নফুলী প্রকল্প অর্থাৎ কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৩২,০০০ একর জমি ডুবিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে জমি ডুবে যায় ৫৪,০০০ একর। এসব জমি ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট কৃষি জমির প্রায় ৪০ শতাংশ। বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিলো সরকারের পক্ষ থেকে। প্রতি একর জমির জন্য জমির শ্রেনী অনুযায়ী ২০০ এবং ৬০০ টাকা। একটি ফলবান বৃক্ষের জন্য উর্ধ্বে ১০ টাকা এবং অফলবান বৃক্ষের জন্য ৫ টাকা। প্রতিটি বসত বাড়ীর জন্য গড়ে ৫০০ টাকা। যা ছিলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল্য।
৭০/৮০’র দশকে জেনারেল জিয়ার আমলে ৪ লক্ষাধিক বহিরাগত সেটেলার বাঙালীকে পুনর্বাসন করানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরপর থেকে শুরু হয় সেটেলার বাঙালী কতৃক আদিবাসী জায়গা জমি জোরপূর্বক দখলদারিত্ব। আদিবাসীরা হতে থাকে ভূমিহারা ও বাস্তচ্যুত। ধীরে ধীরে সেটেলার বাঙালীরা এগোতে থাকে আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন ও গণহত্যার মত বর্বর পরিকল্পনায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের উপর সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালী কতৃক প্রথম হামলা করা হয় ১৯৮০ সালের ২৫শে মার্চ।
ঐদিন কাউখালী থানার সেনাকর্মকর্তা কলমপতি ইউনিয়নভূক্ত নোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরটি আসন্ন কিছু উৎসব উপলক্ষে মেরামতের বিষয়টি আলোচনার জন্য স্থানীয় পাড়াবাসীদের সমবেত হতে নির্দেশ দেন। পাড়াবাসীরা যখন সমবেত হয়, তখন সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সমবেত আদিবাসীদের টার্গেট করে গুলি চালানো শুরু করে। ঐ হামলায় প্রায় ৩০০ জন আদিবাসী নারী পুরুষ নিহত হয়। এবং আরো অনেকেই আহত হয়। তখন থেকেই পরপর করে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালী কতৃক আদিবাসীদের উপর অনেক হত্যাকান্ড চালানো হয়। যা বর্তমান অবদি চলমান রয়েছে!!! আদিবাসী নির্যাতনের ঘটনা প্রচার হয়না, সংবাদ পত্রেও প্রকাশ পায়না। নিরবে আড়ালে থেকে যায়।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে “পার্বত্য চুক্তি” স্বাক্ষরিত হলেও আজ অবদি চুক্তির ২৪টি বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও পার্বত্য চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি আওয়ামীলীগ সরকার। উল্টো একের পর এক পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছে। মূলত আওয়ামীলীগ সরকার ও রাষ্ট্র আদিবাসী বান্ধব নয়। এদেশে আদিবাসী বলে কেউ থাকুক সরকার সেটা মনে প্রাণে চায় না। তাই সরকার এবং তার আমলারা আদিবাসী জাতিসত্বার অস্তিত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আমূল উৎখাত করতে বেশ উদগ্রীব।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকালে সেনাবাহিনীর প্রভাব আরো ব্যাপক ও বিদ্যমান। এখানে প্রতি পদে পদে সেনা ক্যাম্প, বিজিবি ক্যাম্প, পুলিশ ফাড়ি স্থাপন করা হয়েছে। যেসব জায়গায় ক্যাম্প হয়েছে একটা সময় সেসব জায়গায় আদিবাসীদের ঘর-বাড়ী ছিলো। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির পরিপন্থী ক্যাম্প সম্প্রসারণ করতে গিয়ে আদিবাসীদেরকে তাদের বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পরিমাণের অধিক সেনা, পুলিশ, বিজিবি ক্যাম্প থাকা সত্বেও তারা আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এক ইঞ্চি জায়গা ব্যাবধানে সেনা পুলিশ থাকা সত্বেও সেটেলার বাঙালীদের হাতে আদিবাসী মা-বোনেরা ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ কারো রেহাই হয়না ধর্ষণ নামের দানবীয় থাবা থেকে।
পর্যটনের নামে উন্নয়ন করা হচ্ছে! সেই পর্যটনী উন্নয়নের জোঁয়ারে আদিবাসীরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হচ্ছে। যেখানে উন্নয়ন করা হচ্ছে সেখানেও আদিবাসীদের চৌদ্দপুরুষের আবাসভূমি ছিলো। সরকার আদিবাসীদের সেসব আবাসভূমিতে পর্যটন গড়ার নামে সহজভাবে আদিবাসীদের জায়গা জমি দখল করে নিচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে আদিবাসীদের পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে, দুর্গম থেকে আরো দুর্গমে, প্রান্তিক থেকে অনেক প্রান্তিকে।
সেনাশাসন নামের দাবানলের ভয়ে আদিবাসীরা এখন তাদের জন্মভূমিতে ইচ্ছেমত বেড়াতে পারেনা, চলতে পারেনা। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় আদিবাসীদের। আতংকে থাকতে হয়! সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি নিয়ে দিনশেষে তারা শান্তির আড়ালে নিদ্রায় মগ্ন থাকতে পারেনা। না জানি কখন সেনাবাহিনীরা তাদের ধরে নিয়ে প্রমোশন বানিজ্যের পুঁজি হিসেবে ব্যাবহার করে! তারপর সন্ত্রাসীর, রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, বিচ্ছিনতাবাদীর তকমা লাগিয়ে বিনিয়োগ করে দিবে।
আশ্চার্য হওয়ার কিছু নেই। একটা স্বৈরতান্ত্রিক কবলে পড়া দেশে এমনটাই জঘন্য আচরন করা হয় আদিবাসীদের উপর। তবুও অবৈধ ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকা সরকার এবং তার হাইব্রিড মগজধারী আমলারা বলবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা খুব ভালো আছে।
সহায়ক গ্রন্থ: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মজনগণের ইতিহাস (শরদিন্দু শেখর চাকমা)
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ