কল্পনা চাকমাকে দিয়ে শুরু করা যাক। কল্পনা চাকমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন সাহসী নারী। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র লড়াকু নারী সংগঠন “হিল উইমেন্স ফেডারশন” এর তৎসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন কল্পনা চাকমা। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নারী মুক্তির আন্দোলনে তাঁর প্রতিবাদী বজ্রকন্ঠ ছিলো সবসময় সোচ্চার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙ্গামাটি জেলার দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ীতে কল্পনা চাকমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট “ফেরদৌস” এর নেতৃত্বে রাতের আধারে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৪টি বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো অপহরণকারীদের হয়নি সুষ্ঠু বিচার। দেশের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে কল্পনা চাকমা অপহরণের তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচারের দাবি করা হলেও এবং অপহরণ মামলার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও রাষ্ট্রের নানা অজুহাতে থমকে আছে মামলার প্রতিবেদনের কাজ। কারণ রাষ্ট্র মনেপ্রাণে চায় নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার – বিচার-বহিঃর্ভূত প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকুক। ২৪টি বছরেও একটি অপহরণ মামলার সুষ্ঠু বিচার করতে না পারা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাইনবোর্ডধারী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে ব্যর্থতার এবং লজ্জার বিষয়।
এবার আসি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতৃক নানিয়াচর কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী “রমেল চাকমা” হত্যা প্রসঙ্গে। ২০১৭ সালের এপ্রিলের ৯ তারিখ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রমেল চাকমার মৃত্যু হয়। সেসময়ে রমেল চাকমা ছিলেন রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়াচর উপজেলার নানিয়াচর কলেজের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং তিনি ছিলেন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁর ডান চোঁখের উপরিভাগে জন্মগত সমস্যা/অসম্পূর্ণতা ছিলো। নিরীহ গরীব মেধাবী ছাত্র রমেল চাকমাকেও বাঁচতে দেয়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। তাকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো, হত্যা করা হলো তার দীপ্ত প্রত্যয়ে ঘেরা আগামীর স্বপ্নকে। বাবা-মায়ের বুক খালি করে কেঁড়ে নেয়া হল তাদের আদরের সন্তানকে। এভাবেই দিনের পর দিন চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী কতৃক নির্বিচারে হত্যাকান্ড। বিচার বহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতির আড়ালে অকালে জীবন হারাচ্ছে হাজার হাজার রমেল চাকমা। যার কোন বিচার নেই, সম্পূর্ণ থেকে যার বিচার বহির্ভূত প্রক্রিয়ায়। রমেল চাকমা হত্যার প্রতিবাদে কতশত প্রতিবাদ হয়েছে, মানববন্ধন করা হয়েছে, করা হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল। ফলশ্রুতিতে কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। রাষ্ট্র আমাদের ভাই হারানোর আর্ত্মচিৎকার শুনেনি। বুঝতে পারেনি সন্তানহারা বাবা-মায়ের শূণ্যতার দুঃখ, কষ্ট। এভাবেই চলছে স্বাধীন বাংলাদেশে আদিবাসীদের পরাধীন জীবন।
আরেকটা বলি, ২০১৮ সালের ঘটনা। দিনটা ছিলো ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারী। সেদিন ইউপিডিএফ নেতা “মিঠুন চাকমা” খাগড়াছড়ি জেলা আদালতে একটা মামলার হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন। হাজিরা শেষে নিজ বাড়ির দিকে রওনা দিলেন মিঠুন চাকমা। কিন্তু তিনি বাড়ি ফিরতে পারেননি, পথিমধ্যই তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৃষ্ট সন্ত্রাসী (জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ) কতৃক প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমাকে হত্যার পিছনে সেনা-প্রশাসনের যে যোগসাজশ ছিলো তা প্রমাণিত হয় মিঠুন চাকমার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের দিনে। সেদিন সেনাবাহিনী তথা পুলিশ বাহিনী সকাল থেকেই খাগড়াছড়ির মেইন প্রবেশপথসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে মিঠুন চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা লোকজনদের বাধা প্রদান করে। মিঠুন চাকমা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের একজন স্নাতকোত্তরধারী ইউপিডিএফ নেতা। পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ পেয়েও তিনি শিক্ষকতা করেননি। একাধারে তিনি বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখিতেও বেশ মনোনিবেশ ছিলেন। প্রথম বাংলা ব্লগসাইট “সামহ্যোয়ারইন” ব্লগে অধিক সক্রিয় ছিলেন। মিঠুন চাকমার হত্যাকারীরা এখনো প্রশাসনের নাকের ডোগায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু প্রশাসন তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় কিছু করছে না। যার ফলে প্রশাসনের সহযোগীতায় মিঠুন চাকমার হত্যাকারীরাও থাকছে বিচার বহিঃর্ভূত সংস্কৃতির আড়ালে।
সর্বশেষ বলি ২০১৯ সালের কথা। ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা অপহরণ প্রসঙ্গে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বিজু(বৈসাবি) ও রানা প্লাজা ধ্বংসযজ্ঞের বার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচী গ্রহনের জন্য মাইকেল চাকমা শ্রমিক এলাকায় সাংগঠনিক সফরে যান। কাঁচপুর এলাকায় সাংগঠনিক কাজ শেষে ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল বিকালে ঢাকায় কর্মসূচী বাস্তবায়ন পর্যালেচনা সভায় যোগদানের জন্য রওনা দেন মাইকেল চাকমা। এরপর ঐ ৯ এপ্রিল থেকেই তিনি এখনো নিখোঁজ। ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠনগুলোর অভিযোগ মাইকেল চাকমাকে রাষ্ট্রীয় সাদা পোশাকধারী বাহিনী কতৃক অপহরন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ ঢাকার বুকেও কত প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে। বামপন্থী সংগঠনগুলো মাইকেল চাকমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মত প্রতিবাদের ফলাফল শূণ্য। মাইকেল চাকমা কোথায়? তার উত্তর আদৌ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাইকেল চাকমার সন্ধান রাষ্ট্র দিতে পারেনি।
এভাবেই দিনেদিনে অপহরণ, গুম এবং নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছে অনেক প্রতিবাদী কন্ঠ স্বাধীন সার্বভৌমত্বের অধিকারী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিচার বহির্ভূত সংস্কৃতির আড়ালে। কেবল কল্পনা চাকমা থেকে শুরু করে মাইকেল, মিঠুন, রমেল নয়। হাজার হাজার কল্পনা, মাইকেল, মিঠুন, রমেলকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কতৃক নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্টার লড়াই সংগ্রামের বলিষ্ঠ নেতৃত্বকে। এর শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না। তবে আমরা জানি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান আমাদের অধিকারের সুরক্ষা দিলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলো বঞ্চিত।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ