১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ দুইভাগ হয়ে ১৪′আগস্ট সৃষ্টি হয় ‘পাকিস্তান’ এবং ১৫ আগস্ট সৃষ্টি হয় ‘ভারত’ নামক রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম-পাকিস্তানের অবহেলা আর বৈষম্য। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার কথা থাকলেও “মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ” লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করে ঘোষণা করেন একাধিক আলাদা রাষ্ট্র গঠন না হয়ে একটি মাত্র রাষ্ট্র গঠন করা হবে এবং সেটি হবে পাকিস্তান। তার সেই ঘোষণার কারণে বাঙালীদের মনে জন্ম হয় হতাশা। কারণ বাঙালী মুসলমানরা চেয়েছিলো ভারতের পূর্বাংশ নিয়ে একটি স্বাধীন বাঙালী মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করতে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলীম লীগের দলীয় আইন সভার এক কনভেনশনে নীতিবহির্ভূতভাবে “জিন্নাহ” লাহোর প্রস্তাব সংশোধনের নামে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এখান থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপরে ভিত্তি করে নয়, ১৯৪৭ সালের ৯এপ্রিল দিল্লি প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেই রাষ্ট্রের মূলনেতৃত্ব পর্যায়ের ক্ষমতাগুলো (প্রধানমন্ত্রী, গভর্নর জেনারেল) দখল করে নেয় পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতারা। গণতান্ত্রিক এবং সমতার দিক থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার এই দুটি মূল নেতৃত্ব পর্যায়ের ক্ষমতার একটিও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী নেতাদের মধ্যে দেওয়া হয়নি। তৎসময়ে পাকিস্তানে ৫৬.৪০ শতাংশ মানুষের মূখের ভাষা বাংলা হলেও মাত্র ৩.২৭ শতাংশ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দেয়া হয়। অবশ্যই বাঙালী মুসলমানদের চাপের মূখে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়া থেকে বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রাখাটা পশ্চিম পাকিস্তানের একটি মাস্টার প্ল্যান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে একটা সময় স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র দিয়ে রাষ্ট্র শাসন করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সর্বোচ্চ শাসন প্রয়োগ করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশকে অচল করে রাখা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় বাঙালী প্রতিনিধির সংখ্যা ছিলো একেবারে নগন্য। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য পাকিস্তানী শাসকরা জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যায়ভাবে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাতিল করে সরকারকেও উচ্ছেদ করা হয়েছিলো। যার ফলে দেশের জনগন এবং বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের মনে হতাশার অবস্থান আরো গভীর হয়। অবশেষে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে দেশ থেকে জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকারকেও কেঁড়ে নেওয়া হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ‘আয়ুব খান’ মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রতারনা করে ১০ বছর যাবত কোন নির্বাচন ছাড়াই দেশ পরিচালনা করেন!!!
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলক আচরন এবং দমন-পীড়ন ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার দীপ্ত প্রত্যয়ে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ৯মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মূখোমূখী হয়েছিলো বাঙালী জাতী ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতাকামী এই যুদ্ধের মূল নেতৃত্বে মধ্যে অন্যতম একজন বাঙালী নেতা ছিলেন “বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান” (বর্তমানে বাঙালী জাতির পিতা)। নারী-পুরুষ সকলে একাত্ম হয়ে পাকিস্তান সরকারে বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছিলো বাঙালী জাতি। অতঃপর সহস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বাধীনতা। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের।
অধিকার-স্বাধিকারের জন্য লড়াই করা কোন দল বা সংগঠন সন্ত্রাসী হয় না। বর্তমান স্বাধীন বাংলার বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য, জাতির জন্য, জাতীয় অস্তিত্বের জন্য, অধিকারের জন্য, স্বাধিকারের জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলো। কই, কখনো তো বলা হয়নি দেশের স্বাধীনতার জন্যে, দেশের মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করা বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা সন্ত্রাসী। কখনো তো বলা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করা বাংলার সকল মুক্তিযোদ্ধারা সন্ত্রাসী!! স্বাধীনতার জন্যে, অধিকারের জন্যে যুদ্ধ করে, লড়াই-সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ও সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সন্ত্রাসী না হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করা সকল মুক্তিযোদ্ধারা যদি সন্ত্রাসী না হয়, আওয়ামীলীগ যদি সন্ত্রাসী না হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও আদিবাসীদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” (PCJSS) বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী সংগঠন হয় কিভাবে(?) এবং PCJSS-এর সদস্যরা সন্ত্রাসী হয় কিভাবে?
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে যখন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় বৈষম্য থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বৈষম্য শুরু হয় এবং জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয় তখন থেকেই “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” (PCJSS) আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর পক্ষে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ ও জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। আদিবাসীদের অধিকার-স্বাধিকার আদায়ে লড়াই সংগ্রাম করে চলেছে দিনের পর দিন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আদিবাসীদের উপর স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রের আরোপ বেশিগুনে বেড়ে গেলে এবং তারই প্রতিবাদে PCJSS সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হলে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম করে শতশত আদিবাসী অধিকারকামী-স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আদিবাসীদের পক্ষে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” ও তৎসময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ সরকারের “পার্বত্য চুক্তি” নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তিতে নিহিত ছিলো আদিবাসীদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আগামীর স্বপ্নীল প্রত্যাশা। বলা যায় আদিবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের একমাত্র অবলম্বন ছিলো “পার্বত্য চুক্তি”। আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ২২’টি বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি “পার্বত্য চুক্তি” বাস্তবায়নের কাজ। যার ফলে হতাশার একটি বিরাট অংশ জায়গা দখল করে আছে আদিবাসীদের মনে।
সরকারের উচিৎ দেশের সামগ্রিক স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে পার্বত্য চুক্তি দ্রুত এগিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। কিন্ত অপ্রিয় হলেও সত্য এটাই – সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধমে আদিবাসীদের অধিকার-স্বাধিকার ফিরিয়ে দিতে অনিচ্ছুক! পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের দৃষ্টিসম্মত অগ্রগতি তো নেই-ই উল্টো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের প্রভাব ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে সামরিকায়নের মাধ্যমে এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী সেটেলার বাঙালীদের বর্বরতামূখী ক্ষমতা দিয়ে প্রতিটা ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি লঙ্গন করে যাচ্ছে নিরব ষড়যন্ত্রে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আদিবাসীদের জাতিগত অস্তিত্ব চির-উৎখাত করতে নানাভাবে করে যাচ্ছে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র।
সরকারের আদিবাসী অপ্রিয়তা কেবল এখানে সীমাবদ্ধ নয়। আদিবাসীদের নেতৃত্বশূণ্য করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাজনৈতিকভাবে অচল করে রাখতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির” নেতাকর্মীদের উপর ধরপাকড় চালাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। শুধু ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে ক্ষান্ত নয় সরকার, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা অস্ত্রের গুলিতে “PCJSS”-এর নেতাকর্মীদের হত্যা করছে পরিকল্পিতভাবে এবং খুব ঠান্ডামাথায়!
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সরকারের সকল প্রকার বৈষম্য এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার-স্বাধিকার কায়েম করতে PCJSS-এর লড়াই সংগ্রাম আজও থেমে নেই। অধিকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, গণমানুষের মুক্তির পক্ষে লড়াই সংগ্রাম করা কোন দল বা সংগঠন বা তার সদস্যরা সন্ত্রাসী হতে পারেনা। “PCJSS” আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে যদি সন্ত্রাসী হয়; তাহলে বাংলার স্বাধীনতার জন্য, বাঙালী জাতীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল মুক্তিযোদ্ধারা কেন নয়???
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
869 0 - 869Shares