অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও মজুদে ঘাটতির কারণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস বন্ধ রাখার পর নতুন বছরের শুরুতে আবার পেঁয়াজ রপ্তানি শুরুর অনুমতি দিয়েছে ভারত। আর এতে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলছে বাংলাদেশ।
জানা যায়, ভারতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। এতে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার সিদ্ধান্তে ফিরে আসে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সব ধরণের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
গত ১৪ সেপ্টেমবর ভারত পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে সংকট দেখা দেয়। আর এতে দাম বাড়তে থাকে হুহু করে।এক পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৩০ টাকাতেও বিক্রি হয়। এই পরিস্থিতিতে গতবছরের মত মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রঙের ও স্বাদের পেঁয়াজ আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে সরকার। পাশাপাশি ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এদিকে দেশেও নতুন মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় দেশের বাজারেও এখন দাম কমতে শুরু করেছে। গত শুক্রবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে পুরনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। ভারত থেকে পিঁয়াজ এলে তা আরও কিছুটা কমবে বলে ব্যবসায়ীরা আশা করছেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদার প্রায় ৫৭ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে, প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণেই পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে।
আরো জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে শুধুমাত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোন কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু সারা বছরের চাহিদা মেটানোর মতো পেঁয়াজ উৎপাদিত করতে হলে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্তমানে কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হারটা বেশি হয়। আর এতে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি লেগে থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টদের মনে প্রশ্ন, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও কেনো ভারতের পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল? কৃষি সংশ্লিষ্টরা এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের ভালো ও উন্নত বীজের অভাব রয়েছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ চর এলাকা রয়েছে। সেসব জমি যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদার ১০ লক্ষ টনের পুরোটা উৎপাদন করা সম্ভব।
কৃষিপ্রধান দেশ হলেও কৃষিক্ষেত্রে সরকারের উদাসিনতায় বাংলাদেশ আজ কৃষিপণ্য আমদানি নির্ভর হয়ে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, পেঁয়াজের যে ঘাটতির জন্য ভারতের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকতে হয়, সরকার কৃষিক্ষেত্রে নজর দিলেই তা পূরণে সম্ভব। তারা বলেন, এক সময় কৃষকেরা অন্যান্য ফসলের সাথে পেঁয়াজ চাষে গুরুত্ব দিয়ে থাকতেন নিজেদের প্রয়োজনেই। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারা যা বিক্রি করে দিতেন তাতেও স্বনির্ভর ছিল পেঁয়াজের বাজার। এখন আর সেসব দৃশ্য নেই। ঘরে ঘরে তাদের প্রয়োজনীয় পেঁয়াজটাও চাষ করতে আগ্রহ পাচ্ছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এক্ষেত্রে চাষ জমির সংকুচিত হয়ে আসা, সরকারের তরফ থেকে তদারকির অভাব এবং সর্বোপরী পেঁয়াজের বীজ সংকটকে দায়ি করছেন তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/ ১৪৩৪
আপনার মতামত জানানঃ