বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) একাধিক প্রশিক্ষণশিবিরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫০ জনের অধিক জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র–গুলিসহ সাত জঙ্গি ও তিন কেএনএফ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রশিক্ষণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বান্দরবান জেলা পরিষদের মিলনায়তনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১০ অক্টোবর কেএনএফ ও জঙ্গিদের একটি গোপন আস্তানা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তখন থেকে চলমান অভিযানে গতকাল রাতে সাইজামপাড়া থেকে সাতজন জঙ্গি ও রোয়াংছড়ি বাজার এলাকা থেকে তিনজন কেএনএফ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নয়টি এসবিবিএল কার্তুজ বন্দুক, ৫০টি গুলি, ৬২টি কার্তুজের খাপ, ছয়টি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), একটি দেশীয় পিস্তল, একটি ওয়াকি–টকি, ইউনিফর্মসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, বিভিন্ন সময়ে হিজরতের নামে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের মধ্যে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নে এবং ওই ইউনিয়নসংলগ্ন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে। প্রায় দুই সপ্তাহের অভিযানে সাফল্য পাওয়া গেছে।
গতকাল রাতে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মাধ্যমে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমিরের নাম জানা গেছে। সংগঠনটির আমিরের নাম আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। এ ছাড়া শূরা কমিটির সদস্যরা হলেন দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মাইমুন; সামরিক শাখার মাসুকুর রহমান; সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি মারুফ আহমেদ; অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার মোশারফ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টা শামীম মাফুজ।
পাঁচ ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল জঙ্গিরা
বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা তৈরিসহ পাঁচ ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়া তরুণেরা। প্রশিক্ষণ শেষে নাশকতা ও সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
মাসিক তিন লাখ টাকার বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া। তিন বছরব্যাপী এ প্রশিক্ষণের বিষয়ে ২০২১ সালে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিদের চুক্তি হয়েছিল।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার তিন কেএনএফ সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার উপদেষ্টা শামী মাহফুজের সঙ্গে নাথান বমের একটি চুক্তি হয়। ২০২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সদস্যদের কেএনএফের গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ প্রদান করার কথা। এর বিনিময়ে জঙ্গিরা কেএনএফকে মাসিক তিন লাখ টাকা এবং কেএনএফের সদস্যদের সমস্ত খরচ বহন করবে।
২০২৩ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সদস্যদের কেএনএফের গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ প্রদান করার কথা। এর বিনিময়ে জঙ্গিরা কেএনএফকে মাসিক তিন লাখ টাকা এবং কেএনএফের সদস্যদের সমস্ত খরচ বহন করবে।
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয় সংগঠনের দাওয়াতি শাখা হিজরতের নামে বিভিন্ন সদস্য সংগ্রহ করে পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জ্যেষ্ঠ সদস্যদের হেফাজতে ‘সেফ হোমে’ রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সেখানে প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণদের পাহাড়ে কেএনএফের গোপন আস্তানায় নিয়ে আসা হতো।
তরুণদের যেভাবে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করেন
র্যাবের ভাষ্যমতে, প্রাথমিকভাবে উগ্রবাদী এ সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণদের লক্ষ্য বানান। এরপর তাদের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ভিডিও ও ধর্মীয় বিষয়ের অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলতে বিভিন্নভাবে মগজধোলাই করা হতো। যে তরুণেরা পরিবার ছেড়ে আসতেন, তাদের পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। সেখানে তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউসে রেখে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
এ ছাড়া আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদের রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
র্যাব বলছে, চরাঞ্চলে এসব প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো পাহাড়ে। সেখানে অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরি ছাড়াও চোরাগুপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রশিক্ষণ চলছিল। পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে তাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিতেন।
নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজছাত্র নিখোঁজ হন। কিছুদিন পর তাদের একজন ফিরে এলে এই তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়ার বিষয়টি জানাজানি হয়। এর কদিন পর কুমিল্লা শহরের কুবা মসজিদের ইমাম শাহ মো. হাবিবুল্লাহ আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ৫ অক্টোবর সাতজনকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের মধ্যে কুমিল্লার দুজনসহ নিখোঁজ চার তরুণ ছিলেন। বাকি তিনজন জঙ্গি সংগঠক ও আশ্রয়দাতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ