সড়ক দুর্ঘটনায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৪ হাজার ১৬৬ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন জুলাই মাসে। দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যমতে, গত মাসে ৭৩৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই মাসে দেশে ৬৩২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪২ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০৯টি শিশু ও ১০৫ জন নারী রয়েছেন।
গত মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৫১ জন নিহত হয়েছেন। শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন ১০৪ জন। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে জুলাই মাসে ৪১টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ও ৫৮ জন আহত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার পবিত্র ঈদুল আজহার সময়ে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এক জেলার নিবন্ধনকৃত মোটরসাইকেল আরেক জেলায় চলাচল করতে পারবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে জরুরি ক্ষেত্রে পাস নিয়ে চলাচলের অনুমতি ছিল।
সরকারের এই পদক্ষেপের পরও জুলাই মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী নিহত মানুষের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এ ছাড়া নৌ দুর্ঘটনায় ১৮ জন, রেলপথ দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত হয়েছেন গত মাসে।
সংগঠনটি ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
জুলাই মাসে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মাসের শুরুতে ঈদ ছিল। ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়ে যায়। এ ছাড়া মোটরসাইকেল চলাচল সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সড়ক আইন বা নজরদারি বলতে এখন আর কিছু দেখা যায় না। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে অস্থিরতাও বেড়েছে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি এ দেশের জনগণের কপালের লিখন? নিশ্চয় নয়। দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোকে যদি এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখে উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়; তাহলে দেখা যাবে, উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম।
সুতরাং এ দেশের সড়ক-মহাসড়গুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনা জনগণের কপালের লিখন নয় কিংবা ভাগ্যদেবীর নির্মম পরিহাসও নয়।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে; সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতা প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন কিংবা রাস্তায় চলাচলের নিয়ম না মানা প্রভৃতি।
এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গড় দেড় বছরে শুধু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ২০০ জন।
আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর দেশের সড়কপথে অন্তত পাঁচ হাজার দুর্ঘটনা ঘটছে আর এক বছরেই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং পঙ্গুত্ব বরণ করছেন এর দ্বিগুণ।
এক্ষেত্রে সরকারি আর বেসরকারি হিসাবের সংখ্যাগত পার্থক্য থাকলেও দেশে যে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক মানুষের প্রাণহানি হওয়াসহ পঙ্গুত্ব বরণের ঘটনা ঘটছে, মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে; সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক সময় ভাংচুর ও নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটছে এবং এর ফলে সাধারণ মানুষ যে কঠিন ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছে; সেসব বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই।
দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে যে হারে বাড়ছে, তা যদি অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করা হয়, তাহলে আগামীতেও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পাশাপাশি জনগণ আহত-নিহত হতেই থাকবে।
সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোও নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবে দেশে অনেক সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে চালকদের গাড়ি চালানো, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক বিদ্যমান থাকা, রাস্তার ত্রুটিপূর্ণ নকশা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, চালকদের বেপরোয়া গতিসহ ভুলপথে গাড়ি চালানো, বেশি গতির বড় গাড়িগুলোর অপেক্ষাকৃত কম গতিসম্পন্ন ছোট গাড়িগুলোকে ওভারটেকিং করার মানসিকতা থাকা, রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী বা পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, ফুটপাত ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে পথচারীদের চলাচল, রাস্তা পারাপারের জন্য অনেক সময় ওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে জনগণ কর্তৃক রাস্তা পার হওয়া, রাস্তার ওপর এবং ফুটপাতে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলের জন্য যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে, তা জনগণ কর্তৃক না মানা।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। একদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া; অন্যদিকে অদক্ষ চালককে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিয়ে, ট্রাফিক আইন না মেনে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য কোনো কঠিন বিষয় নয়।
এজন্য দরকার সরকার ও জনগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন।
রাস্তার ওপর ফুটপাতে দোকানপাট স্থাপনসহ ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হকারদের ব্যবসা করার ‘সুযোগ’ করে দেয়া, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি, খেয়াল-খুশিমতো যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করা, সড়ক-মহাসড়কের ওপর রিকশা, ভ্যান, ট্যাম্পু, ম্যাক্সি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড স্থাপন করা, রাস্তার মাঝখানে ডাস্টবিন স্থাপন করা, সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে একই রাস্তা বছরে বারংবার খনন করা, জনগণ কর্তৃক রাস্তা পারাপারের নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে না মানার কারণে এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে স্মরণে রাখতে হবে, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি মানে শুধু দেশকে গ্লোবাল ভিলেজের মতো করে ছোট করে আনা নয়; বরং সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে মানুষের অমূল্য জীবন দুর্ঘটনামুক্ত রাখাটাও কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য।
মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ চালকদের ‘ওভারটেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন।
তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা বা শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সবারই সচেতন দরকার। সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা আছে, তা যে কোনো মূল্যে দূর করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদ না হয়ে নিরাপদ হয়ে ওঠবে, যা সবার একান্ত কাম্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ