জেরুজালেমের ওপর বিভিন্ন ক্ষমতার করায়ত্ত এবং অত্যাচারের পেছনে বিবিধ রাজনৈতিক কারণের অন্যতম হলো, এখানে পৃথিবীর প্রাচীনতম ইবাদাত গৃহসমূহ স্থাপিত। এবং দুটি প্রধানতম ধর্মীয়গোষ্ঠীর অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। অপশক্তির নানা কুদৃষ্টিতে বিভিন্ন সময়ে এ স্থানের বাসিন্দা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ অত্যাচারিত হয়ে আসছে; ইতিহাস তার সাক্ষী।
স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। জেরুজালেমের এই স্থানটিকেই নিজেদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরাও। এনিয়ে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধেও রূপ নিয়েছে।
চলতি বছরের রমজান মাসেও ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশটির পুলিশ ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। আর ইহুদিদের কাছে এটি খ্যাত টেম্পল মাউন্ট নামে। তারাও এটিকে তাদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে আরব স্ট্রিটে কয়েকটি মারাত্মক হামলার পর ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। এর মধ্যে পবিত্র মসজিদ আল-আকসার প্রাঙ্গণে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস এলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইসরায়েল। চলতি বছরের পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজেন জাবারি আল-জাজিরাকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে তা বড় ধরনের বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত।
গত বছর জেরুজালেমে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন্দ্র করে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনিদের ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনজুড়ে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
এ বছরের মতো ঠিক গতবারও আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবেশ ও অভিযান আগে থেকেই চলে আসা দুই পক্ষের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ওই অভিযানের চার দিন পর গাজায় টানা ১১ দিন স্থল ও বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় কয়েক শ মানুষ হতাহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ ছিল শিশু। হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গাজার বাড়িঘরসহ বহু স্থাপনা। বাদ পড়েনি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ঘটনা নিয়ে ইসরায়েল বলেছিল, হামাসের রকেট ছোড়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা গাজায় অভিযান চালিয়েছে মাত্র।
গত রমজানের সংঘর্ষের পর সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা এবার ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের আরেকটি লড়াইয়ের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাজেন জাবারি বলেন, এবারের সংঘর্ষ শুধু যে জেরুজালেমের দিক থেকে শুরু হতে পারে তা নয়, বিভিন্ন দিক থেকেই শুরু হতে পারে। যেমন জেনিনে (পশ্চিম তীরের শহর) বিস্তর সংঘর্ষ হতে পারে। কারণ ইসরায়েল ওই শহরে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামার কথা বলতে পারে তারা।
গাজার শাসনক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আবার লড়াইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদি ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা আল-আকসা মসজিদ নিয়ে তাদের অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়ে যেতে থাকেন, তবে হামাস বসে থাকবে না।
এবার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরে ইহুদিদের প্রার্থনা বন্ধের আহ্বান জানালো আরব লীগ। ফিলিস্তিনের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে এই ধরনের কর্মকাণ্ড মুসলিম অনুভূতির জন্য স্পষ্ট অপমান এবং এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষের সূত্রপাত হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে জোটটি।
পবিত্র আল-আকসা মসজিদ ঘিরে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা চললেও এতোদিন নীরব ছিল আরব দেশগুলোর জোট আরব লীগ। তবে ইসরায়েলি কর্মকাণ্ড ও সাম্প্রতিক সহিংসতার বিষয়ে বৃহস্পতিবার জোটটি জানিয়েছে, জেরুজালেমের পুরনো শহরে মুসলমানদের ইবাদতের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে ইসরায়েল। এর পাশাপাশি পুলিশি নিরাপত্তার মাধ্যমে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের পবিত্র এই স্থানে প্রবেশের সুযোগও করে দিচ্ছে দেশটি।
ফিলিস্তিন ও আল আকসার পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার জর্ডানের রাজধানী আম্মানে জরুরি বৈঠকে বসে আরব লীগ। বৈঠকে জেরুজালেমে ইসরায়েলের অবৈধ নীতি ও পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বৈঠকের পর জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইমান সাফাদি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দাবি স্পষ্ট যে, আল আকসা এবং হারাম আল শরীফের পুরো এলাকাটি একমাত্র মুসলমানদের ইবাদত করার জায়গা।’
এদিকে আরব লীগের প্রধান আহমেদ আবুল ঘেইত বলেছেন, বহু শতাব্দীর পুরনো একটি নীতি লঙ্ঘন করছে ইসরায়েল। পুরনো এই নীতি অনুসারে, অমুসলিমরা আল-আকসা প্রাঙ্গণে যেতে পারে, কিন্তু তারা (অমুসলিমরা) সেখানে প্রার্থনা করতে পারবে না।
চলতি সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে কথা বলেছেন জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইমান সাফাদি। এছাড়া পবিত্র স্থানটিতে উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে আলোচনার জন্য গত বুধবার এই অঞ্চলে সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথেও দেখা করেছেন তিনি।
আইমান সাফাদি বলেছেন, ইহুদি উপাসকদের আল-আকসায় প্রবেশ বন্ধ করা হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করেছে ইসরায়েল। গত রোববার অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশের প্রবেশের পর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আবারও সংঘর্ষ হয়। এতে ২০ জন আহত হয়েছিলেন। স্থানীয় সময় রোববার ফজরের নামাজের পর ইসরায়েলি পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। মূলত সেসময়ই ফিলিস্তিনিদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত শুক্রবার আল আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশের অভিযানে দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হন। এছাড়া প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনিকে আটক করে ইসরায়েল। শুক্রবার থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি মসজিদে জড়ো হচ্ছেন এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
মুসলিম ও ইহুদি, দুই ধর্মাবলম্বীদের কাছেই ঐতিহাসিকভাবে আল আকসা মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র স্থান। মুসলিমদের জন্য পবিত্র আল আকসা মসজিদটি তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। আর মসজিদ চত্বর মুসলিমদের কাছে হারাম-আল-শরীফ হিসেবে পরিচিত।
অবশ্য ইহুদি ধর্মাবলম্বীরাও এটিকে নিজেদের বলে দাবি করে থাকে। আর সেটি নিয়েই বহু যুগ ধরে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বন্দ্ব। ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা আল আকসা মসজিদ ও তার আশপাশের অংশকে ‘টেম্পল মাউন্ট’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে এবং তাদের জন্য এটি বিশ্বের সবচাইতে পবিত্র স্থান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ