বিশ্ব যেন আবার এক অদেখা আতঙ্কের মুখোমুখি। বহু বছর পর বিশেষজ্ঞরা যে ধরনের ফ্লু ভাইরাসের বিস্তার দেখছেন, তা তাদের বিস্মিত করছে, উদ্বিগ্ন করছে, আর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য তৈরি করছে নতুন প্রশ্ন। ইনফ্লুয়েঞ্জা এ–এর এইচ-থ্রি-এন-টু ধরনের যে নতুন রূপ—যা এখন ‘সাবক্লেড কে’ নামে পরিচিত—তা শুধু একটি মৌসুমি অসুখের গল্প নয়, বরং সাম্প্রতিক সমাজ-বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মহামারির পর আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওঠানামা, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের পুনরুত্থান, এবং স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার মতো নানা উপাদান এই নতুন ফ্লু মৌসুমকে করেছে ভয়াবহতর, জটিলতর। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে ভাইরাসটির মুখোমুখি হয়নি, সেটি যখন আচমকা নতুন রূপে নিজেকে উপস্থাপন করে, তখন শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাকে চিনতেই পারে না; প্রতিরোধ তো দূরের কথা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নতুন সাবক্লেডের বিস্তার নিছক সাধারণ মিউটেশনের ফল নয়। সব ভাইরাসই নিয়মিতভাবে রূপ পরিবর্তন করে, কিন্তু সাতটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন যুক্ত হয়ে এইচ-থ্রি-এন-টু–এর যে আদল তৈরি হয়েছে, তা বিজ্ঞানীদের চোখে ‘অস্বাভাবিক’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথোজেন ইভোলিউশন সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডেরেক স্মিথ ইতোমধ্যেই সতর্ক করে বলেছেন—এটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বেই এবং তার গতিবিধিতে এমন আচরণ দেখা যাচ্ছে, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো মৌসুমি ফ্লুতে দেখা যায়নি। একই কথা বলছেন ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরাও—তাদের মতে, ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার ধরন একদিকে দ্রুত, অন্যদিকে অপ্রত্যাশিতভাবে ‘অ্যান্টিজেনিকালি’ ভিন্ন। এই ভিন্নতাই বর্তমান ভ্যাকসিনগুলোর সঙ্গে এর সামঞ্জস্য কমিয়ে দিয়েছে, যেটি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
মানুষ সাধারণভাবে ফ্লুকে ততটা ভয় পায় না—বিশেষত কোভিড-১৯ এর অভিজ্ঞতার পর। অনেকেই মনে করেন, ফ্লু মানেই কয়েকদিনের জ্বর, গা-মাথা ব্যথা আর বিশ্রামের পর সুস্থ হয়ে ওঠা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা এবার ভিন্ন। ভাইরাসটি যে মানুষ দীর্ঘদিন দেখেনি, সেজন্য স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম—ফলে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে বহু গুণ। একই সঙ্গে ভাইরাসটি দ্রুত শরীর থেকে শরীরে ছড়াচ্ছে—যার অর্থ, একজন আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে অনেকেই খুব সহজে সংক্রমিত হতে পারেন। তবে উপসর্গ আগের বছরের তুলনায় ‘অত্যন্ত মারাত্মক’ হবে এমনটি নয়। সমস্যা হচ্ছে, সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়বে, ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের মধ্যে জটিলতা দেখা দেবে বেশি। শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী নারী এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম—তাদের জন্য পরিস্থিতি খুব দ্রুতই উদ্বেগে রূপ নিতে পারে।
বিশ্বজুড়ে যে অসুস্থতার ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপরও পড়ছে। জাপানে এবং যুক্তরাজ্যে মৌসুমি ফ্লু শুরু হয়েছে বছরের অনেক আগেই, এবং স্কুলগুলোতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিছু স্কুল তো বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে বন্ধও রাখতে হয়েছে। শিক্ষক-অভিভাবকদের উদ্বেগ বেড়েছে দ্বিগুণ—কারণ শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ালে তা ঘরে, কর্মস্থলে এবং জনপরিবহনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে, সর্দিজ্বর, ফ্লু ও কোভিড—এই তিনটি রোগের উপসর্গের মিল মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বেশি। অনেকেই বুঝতে পারছেন না ঠিক কোন অসুখে তাঁরা আক্রান্ত। সর্দি ধীরে শুরু হয়, নাক ও গলার পেছনের অংশকে প্রভাবিত করে। ফ্লুতে উপসর্গ হঠাৎ করেই আসে—উচ্চ জ্বর, শরীর ব্যথা, চরম দুর্বলতা। কোভিড আবার কখনো ফ্লুর মতো, কখনো ভিন্ন—বিশেষত স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়া ও তীব্র গলা ব্যথা হলে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন কোভিড হয়েছে। উপসর্গের এই আংশিক মিল মানুষকে সতর্কতা নিতে বিলম্বিত করছে, এবং চিকিৎসা নিতে দেরি করাচ্ছে। এর ফলে সংক্রমণ অজান্তেই বাড়ছে। মৌসুমি অসুখের জটিলতা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে—স্বাস্থ্যবিধি শুধু মহামারি এলে মানলেই হয় না; দৈনন্দিন জীবনের একটি অভ্যেসে পরিণত হওয়া উচিত।

প্রতিরোধের কথায় আসলে বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে যে বিষয়টি বলছেন, তা হলো ভ্যাকসিন। যদিও এই বছরের ভ্যাকসিনগুলো নতুন মিউটেটেড ভাইরাসের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—তবুও তারা বলছেন, “কিছু সুরক্ষা কোনো সুরক্ষা না থাকার চেয়ে ভালো।” অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যান্ডেমিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ক্রিস্টোফ ফ্রেজার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় কাজ হলো রোগের তীব্রতা কমিয়ে আনা। অর্থাৎ আপনি অসুস্থ হতে পারেন, কিন্তু তা গুরুতর অবস্থায় উন্নীত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকবে। যারা ভ্যাকসিন নেননি, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে বেশি—বিশেষত এই নতুন সাবক্লেডে, যা আগের ভাইরাসগুলোর তুলনায় অ্যান্টিজেনিকভাবে বেশি ভিন্ন। ফলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তা শনাক্ত করতে সময় নেয়, আর ততক্ষণে এটি দেহে প্রভাব বিস্তার করে ফেলে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিনের প্রাপ্তি নিয়ে পার্থক্য আছে। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগা মানুষ বা গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। অন্যরা চাইলে অর্থ দিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু অনেক উন্নয়নশীল দেশে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা এখনো চ্যালেঞ্জ। বিশেষত যেখানে জনসংখ্যা ঘনত্ব বেশি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সীমিত, সেখানে মৌসুমি ফ্লুর ঢেউ সহজেই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। মহামারির পর টিকা সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও মৌসুমি ফ্লুর মতো অসুখের জন্য জনস্বাস্থ্য কাঠামো এখনো প্রস্তুত নয় অনেকখানিই।
প্রতিরোধ শুধু ভ্যাকসিনেই সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিও এখানে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, টিস্যু ব্যবহার করা, সাবান ও কুসুম গরম পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার মতো অভ্যাসগুলো আবারও গুরুত্ব পেয়েছে। যে মানুষগুলো ফ্লুতে আক্রান্ত, তাদের বাড়িতে থাকা উচিত—বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়াই ভালো। যদি যেতেই হয়, খোলা জায়গায় থাকা এবং অন্যদের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। মাস্ক পরাও কার্যকর একটি উপায়—বিশেষত জনসমাগমপূর্ণ স্থানে। অনেকেই ভাবেন, ফ্লু তো নিজে থেকেই সেরে যায়; মাস্ক পরা কি এত জরুরি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হ্যাঁ—কারণ ভাইরাসটি কেবল আপনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; আপনার চারপাশের মানুষদের জীবনেও তা প্রভাব ফেলতে পারে।
মানুষের ব্যক্তিগত আচরণই শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। তাই সচেতনতা বাড়ানো, সহজ ভাষায় তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং ভুল ধারণা দূর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তথ্য ছড়ায়—এর মধ্যে কিছু সঠিক, কিছু ভুল। ফলে মানুষ কখনো বিভ্রান্ত হয়, কখনো আতঙ্কিত হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার ভাষায় বলছেন—এটি আতঙ্কের সময় নয়, বরং সতর্কতার সময়। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কয়েকটি সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
বিশ্ব এখন যেন আরেকটি বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে—যেখানে ভাইরাসের বিবর্তনও মানুষের আচরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। শহরগুলো আবার ব্যস্ত, ভ্রমণ বেড়েছে, সামাজিক দূরত্ব মানার অভ্যাস শিথিল হয়েছে, স্কুল-কলেজ-অফিস খুলে গেছে। মানুষের এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আনন্দের মাঝেই ভাইরাসটির জন্য তৈরি হয়েছে নতুন সুযোগ। ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েক বছর হয়তো আমাদের আবারও মৌসুমি ফ্লুকে গুরুত্ব দিতে হবে, যেভাবে আগে কোভিডকে দিয়েছিলাম। নিয়মিত টিকাদান, জনস্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, এবং দ্রুত সংক্রমণ শনাক্ত করা—এসবই নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবু আশা আছে। বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির জেনেটিক পরিবর্তন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ভবিষ্যতের ভ্যাকসিনগুলো আরও বেশি কার্যকর হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। নতুন সাবক্লেডটি যে আচরণ দেখাচ্ছে, তা শিখে বিজ্ঞানীরা আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে পারবেন। মানবসভ্যতা বহুবারই দেখিয়েছে—মহামারি হোক বা মৌসুমি অসুখ, বিজ্ঞান ও সচেতনতার সমন্বয়ে তা মোকাবিলা করা সম্ভব। আজকের এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিও একদিন গল্প হয়ে থাকবে; তবে এখনই প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় পদক্ষেপ নেওয়া, ঝুঁকি কমানো এবং নিজের সঙ্গে অন্যদেরও রক্ষা করা।
আপনার মতামত জানানঃ