মীর মোনাজ হক, বার্লিন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, আগামী বছর আমরা স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পালন করবো। এই দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশের ও বাঙ্গালীর মননের কতটকুক পরিবর্তন হয়েছে সেই আলোচনার আগে প্রাচীন গ্রিসের এক গল্প বলি, যা অধ্যপক শওকত হোসেন, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর লেখায় পড়েছিলামঃ
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যখন সারাবিশ্বে বিপুল প্রতাপশালী সম্রাট ও বিজয়ী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই সময় তিনি একদিন তার পর্যাপ্ত দেহরক্ষী ও প্রটোকল নিয়ে গ্রিসের কোরিত্থ অঞ্চলের একটি পতিত মাঠের একপাশে বসবাসকারী এক ব্যক্তির গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। গৃহ বলতে তার একটা মাথা গুজাবার এক ছোট্ট ডেরা ছিলো, তাঁর বিছানা ছিলো একটি বিশালাকার সিরামিকের কলসের মধ্যে যে কলসগুলো প্রাচীন গ্রিসের মানুষরা আঙ্গুরের রস থেকে সুরা তৈরির কাজে ব্যবহার করত। যাই হোক, লোকটি একদিন তার কলসের মধ্যে থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে বসে শরীরে রোদ লাগাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই আলোকজান্ডার তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানালেন। লোকটি একবার তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি তখন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বললেন : ‘আমি আলেকজান্ডার, সম্রাট ফিলিপের পুত্র সম্রাট আলেকজান্ডার।’ লোকটি তাতেও কোনো পাত্তা দিলেন না। শুধু বললেন : ‘তাতে আমার কী।’ আলেকজান্ডার তখন অনেকটা বিচলিত হয়ে বললেন, ‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’ লোকটি বললেন, আপাতত ‘আমার ওপর থেকে তোমার ছায়াটি সরিয়ে নাও। প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ সূর্যের আলো আসতে দাও।’ আলেকজান্ডার লোকটিকে স্যালুট দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য শুধু ঘাড় ঘোরালেন, লোকটি তখন তাকে বললেন, ‘শোন, যা তুমি দিতে পার না, তা কখনও কেড়ে নিও না।’ আলেকজান্ডার ফিরে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন, তার এই সফর একেবারে অসফল হয়নি; তিনি যতটুকু শিখেছেন তার মূল্য অনেক। মূলত শিক্ষা লাভের জন্যই তো তিনি লোকটির কাছে এসেছিলেন। তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ও প্রিয় মানুষ অ্যারিস্টটল তাকে এই ব্যক্তির কথা বলেছিলেন। গুরুর কথা মোটেই অমুলক নয়। তিনি ভাবতে লাগলেন, শাসক এবং বিজয়ী হিসেবে তিনি অনেক মানুষের কাছে থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছেন। এমনকি কেড়ে নিয়েছেন মানুষের প্রাণ, যা তিনি কখনোই ফিরিয়ে দিতে পারেন না। তিনি আলো, বাতাস বা পানি যা ছাড়া আমরা একেবারেই বাঁচতে পারি না, তার কোনোটাই সৃষ্টি করতে পারেন না। ‘আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’ হিসেবে তার যে উপাধী রয়েছে তার প্রতি তার ধিক্কার এলো। ক্রমে ক্রমে ওই কলসবাসী মানুষটির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকল এবং পরবর্তী সময়েও তার কাছে তিনি হাজির হয়েছিলেন। এই ব্যক্তিই হলেন ডায়োজেনিস (৪১২/৪০৪ খ্রি. পূ.-৩৩২৩ খ্রি. পূ.)। যিনি Diogenes of Cynic বলে পরিচিত ছিলেন। কারণ প্রাচীন গ্রিসের সক্রেটিস-উত্তর সময়ের ‘সিনিক’ নামক একটি বিখ্যাত দার্শনিক সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। প্রায়োগিকভাবে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সার্থক জীবনের প্রশিক্ষণ দেওয়াই এই দার্শনিক সম্প্রদায়ের মূল লক্ষ্য ছিল।
এবার বাংলাদেশের আলোচনায় আমার বিশ্লেষণ হলো, ৫০ বছর একটা জাতির জন্যে বিরাট সময়, বাঙ্গালিরা কোন ‘আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’ পায়নি কোন ডায়োজেনিস এরও জন্ম হয়নি। হ্যাঁ, গ্রেট একজন ছিলেন তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরের মাথায় হত্যা করেছে। এখন একজন এসেছেন যিনি তাঁরই সন্তান, তিনি জনগনকে আলোকিত না করে তাদের উপর এক দানবীয় ছায়া ফেলে রেখেছেন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বিরাট অংশ মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। কোমলমতি শিশুদেরকে মাদ্রাসা নামক এক কুয়োয় বন্ধ করে, তাদের সুকুমার বৃত্তিকে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রেখে শুধু কোরান শিক্ষা দিয়ে একটা জাতি গঠন করার সুযোগ দিয়েছেন। এই বিরাট সংখ্যক শিশু কিশোর পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদেরকে দর্শন শেখানো হয়না, বিজ্ঞান শেখানো হয়না এমনকি বাইরের মুক্ত পরিবেশে ছুটে বেড়ানোর ফুরসতও তাদের নেই বললেই চলে। এই সীমাবদ্ধতায় শিশুরা বেড়ে উঠছে এক অস্বাভাবিক পরিবেশে, তাদের নৈতিক বিকাশ হয়ে উঠছে নেতিবাচক। আবার সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাতেও ঢুকে গেছে দুর্নীতি, যেভাবেই হোক শুধু সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়ে, নিজেরাও ঘুষ দুর্নীতির আশ্রয়েই সকলে ব্যস্ত। যুবসমাজের মধ্যে খুব কম ছাত্রই আছে যারা দর্শনশাস্ত্র পড়তে যায় বা নৈতিক শিক্ষা সমাজবিজ্ঞান পড়তে যায়। অর্থাৎ মানুষ হবার জন্য যেসব গুণাবলি থাকা দরকার তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধ লালন করা, মানবতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করা, সেটা থেকে তারাও বঞ্চিত। অর্থাৎ এদেশে নির্বিশেষ শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর মানুষ শিষ্টাচার কিছুটা মেনে চললেও মানবিকতায় এখনো আদর্শবাদী বাঙালি জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। এজন্যই এ সমাজে পাশবিকতা আছে, আছে অপরের ক্ষতি করে নিজে সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা।
সরকার প্রধান নিজে ধার্মিক হতে পারেন, কিন্তু জাতিকে ধার্মিক বানোবার ব্যবস্থা করার চেয়ে মানুষদেরকে সুশিক্ষিত করার দায়িত্ব আছে তার।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন৷ অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
এখন শুরু হয়েছে ‘মূর্তি বনাম ভাস্কর্য বিতর্ক’, মৌলবাদী সংগঠন হেফাজিতের সাথে আওয়ামী লিগের।
একজন ব্লগার লিখেছেন – ‘একটি জাতির দার্শনিক মৃত্যু কি টের পাচ্ছেন? বঙ্গবন্ধুর চিন্তার আধিপত্য নয়, বাড়ছে মাওলানা শফির চিন্তার আধিপত্য! মাওলানা ভাসানী নয়, মণি সিংহ নয়, তাজউদ্দীন নয়, লালন নয়, রবীন্দ্রনাথ নয়, নজরুল নয়, রোকেয়া নয়, অধ্যাপক রাজ্জাক, আনিসুজ্জামান, অজয় রায়, আহমদ ছফা, সেলিম আল দীন বা শাহ আবদুল করিম নয়, আমাদের মগজ দখলে যাচ্ছে বাবুনগরিদের! তাও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগ যখন প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় তখন!
এখানেই প্রশ্ন পলিটিকাল জিডিপির। অর্থনৈতিক জিডিপি’র আলাপতো অনেক হলো। সাংস্কৃতিক জিডিপি’র আলাপ করছেন কি সরকারি দল? ওরা ভাস্কর্যে আক্রমণ করছে, সংস্কৃতিতে আক্রমণ করছে, শিক্ষায় করছে!
সরকার নিজে টিকে থাকার জন্যে দীর্ঘকাল ধরে তথাকথিত ইসলামের হেফাজতজারীদের সাথে আপোষ করতে গিয়ে সাংবিধানিক সংকটে পড়ে গেছে। এখন এই মৌলবাদী হেফাজতি সংগঠন ফতোওয়া জারী করে মূর্তি থাকবেনা ভাস্কর্যও থাকবেনা এই ফতোওয়া দিচ্ছে, সরকার সেটা এতোদিন খেয়ালই করেনি যে এটা সেকুলার সংবিধানের পরিপন্থী। এখন যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা শুরু করেছে, তখন সরকার টের পাচ্ছে, মেখে মেঘে বেলা হয়েছে অনেক এখন আর স্বাভাবিক ভাবে সেটার পরিত্রান নেই একমাত্র আদালত ছাড়া। “উগ্র ইসলামপন্থী” দেরকে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান দুধকলা দিয়ে এতোদিন পুশেছেন এখন তারাই জাতীর পিতার ভাস্কর্য ভাঙ্গে!
তাই প্রথমেই যে গ্রিক দর্শন থেকে লিখেছিলাম ডায়োজেনিস ‘আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’ কে বলছে “আমার ওপর থেকে তোমার ছায়াটি সরিয়ে নাও” বাঙ্গালীকে আলোকিত হতে দাও।
০৭ ডিসেম্বর, ২০২০, বার্লিন
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক। বার্লিন, জার্মানী।
আপনার মতামত জানানঃ