গত রবিবার (২০ জুন) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সভাপতিত্বে সড়ক পরিবহণ বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। বন্ধের কারণ হিসাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ব্যাটারি চালিত রিক্সা ভ্যান যান্ত্রীক সামর্থ্যের অভাবে সহজেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুর্ঘটনাকে কারণ ধরে রাস্তা থেকে ব্যাটারি চালিত রিক্সা ভ্যান বন্ধ করে দেওয়া সরকারের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাবটিই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একইসাথে সরকারের এই সিদ্ধান্তে বলির পাঁঠা হতে যাচ্ছে অসহায় নিম্নবিত্তদের একটা শ্রেণি, যারা দিন আনতে পান্তা ফুরায় পরিবারের জন্য এক থালা গরম ভাতের আয়োজন রাখতে পেরেছিল।
প্রথমেই আমাদের জানা জরুরি যে কোন শ্রেণিটা ব্যাটারি চালিত যান চালায়। আমাদের দেশে রিক্সার প্রচলন পুরনো হয়ে গেছে। এক রিক্সায় চড়ে আমরা আমাদের দৈনন্দিন চলার সংক্ষিপ্ত পথটি সহজেই পারি দিতে পারি। রিক্সায় চড়ার সুবিধা ভোগ করেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া সত্যিই কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। রিক্সার এত সুবিধা থাকা সত্বেও রিক্সা চালকদের বিষয়ে আমাদের মানসিকতার তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। রিক্সা চালনাকে রাষ্ট্রের, সমাজের নিম্ন শ্রেণির কাজ বলে এক ধরনের হেয়-প্রতিপন্ন করার রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। যেমন কৃষিকাজ আমাদের অন্নের সংস্থান তথা খাদ্যে বাঁচিয়ে রাখলেও কৃষি বিষয়ে আমাদের মানসিকতায় এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে, যেখানে কাজকে নাক সিটকিয়ে দেখার পাশাপাশি কৃষককেও সেকেলে ও নিম্নকর্মের কর্মী হিসাবেই বাঁকা দৃষ্টি দেওয়া হয়। রিক্সা চালকদের বিষয়ে তেমনি এক মনোভাব রয়েছে। ফলে যে কেউ বাধ্য হলেও রিক্সা চালিয়ে উপার্জনের সাহস করতে পারে না।
এক্ষেত্রে ব্যাটারি চালিত রিক্সা কিংবা ভ্যান আমাদের এক শ্রেণির মানুষকে জীবিকায় ফেরাতে পেরেছে। এই শ্রেণির মানুষ অনেকটা মধ্যবিত্ত সংকটে ভোগে। একদিকে রিক্সা চালকদের নিয়ে নিজ সমাজের প্রচলিত নাক সিটকানো ধ্যান ধারণা অন্যদিকে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ। এই সংকটে ভোগা শ্রেণির সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। যারা মফস্বল কিংবা মফস্বল কেন্দ্রিক গ্রামের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন এমন সংকট আমাদের সমাজে কেমন নাজেহাল পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছে। যেহেতু আমাদের সমাজ থেকে এখনো কর্মের বৈষম্য দূর হয়নি উল্টো আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। মানসিক সংকটে পড়া এই শ্রেণির নিকট ব্যাটারি চালিত রিক্সা অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাসের মত ধরা দিয়েছে। নিজেদের কর্মে ফেরার পাশাপাশি পরিবারেও কিছুটা আলো ফেরাতে সক্ষম হয়েছে।
এই শ্রেণির বাইরে, ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও ভ্যানের উপযোগিতা উপলব্ধি করে পেশি শক্তি ব্যবহার করে রিক্সা চালকেরাও আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরিশ্রম কম, দ্রুত গন্তব্যে পৌছানো যায়, যাত্রী বেশি হলেও টানার ক্ষেত্রে আগের মত আপত্তি উঠছে না, শারীরিক গঠন আর শক্তি সামর্থ্যে দুর্বলরাও চালাতে সক্ষম ইত্যাদি নানা কারণে তাদের নিকট ব্যাটারি চালিত রিক্সাই হয়ে উঠেছে জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। যাত্রীরাও যে এসব রিক্সার সুবিধা ভোগ করছে না, তা নয়। যাত্রী ও চালকের নিকট আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ জাগাচ্ছে বলেই দিন দিন যানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন চালকেরা ব্যাটারি দিয়ে নিজেদের মত করে নানা গবেষণা চালিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহার্য যান কিংবা অন্যকোথাও ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপভোগ করছেন।
এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, কোনো কিছু আবিষ্কার হলে সেটা আমাদের প্রয়োজনীয়তার অনুকূলে আনা, ক্ষতিকর দিকটি অনুজ্জ্বল রেখে ব্যবহারিক সুবিধা স্পষ্ট করে মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো, এসবই পুরনো কথা। কিন্তু এই পুরনো কথাটাই নতুন করে বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, আমাদের সরকার মানুষের ব্যবহার উপযোগী চিন্তা বাদ দিয়ে সেটা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেই পুরনো প্রবাদ প্রবচন আবারও আওড়াতে হচ্ছে, মাথা ব্যথার জন্য সরকার আসলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
কোন প্রযুক্তির যদি যান্ত্রিক সমস্যা থাকে এবং প্রযুক্তিটা যদি প্রয়োজনীয় হয় তাহলে মানুষ সেটার সমস্যা সমাধান করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। পুরোপুরি নিষিদ্ধের প্রশ্ন তখনই আসে যখন এটা প্রমাণিত হয় যে সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য। ব্যাটারির মাধ্যমে মোটর ঘোরানোর মধ্যে কোন যান্ত্রিক বিপদ নেই, সরকারের পক্ষ থেকে ব্রেক ও ব্যালেন্সের যে কথা বলা হয়েছে সেটা গুরুতর কোনো সমস্যা নয় যা সমাধান অযোগ্য। বরং সারা দুনিয়া সেদিকেই যাচ্ছে। গ্রাম কিংবা মফস্বলে ব্যাটারি রিক্সার জনপ্রিয়তা দেখে সহজেই বোঝা যায় রিক্সা চালক এবং যাত্রী উভয়ের কাজে লাগছে বলেই এটা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
ব্যাটারি চালিত রিক্সা যদি এতই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় তবে ইউরোপ আমেরিকায় কেন ব্যাটারি চালিত সাইকেল অনুমোদিত? জাপান কোরিয়াসহ এশিয়ার প্রতিটা উন্নত দেশেই তো ব্যাটারি চালিত সাইকেল চলছে। কারণ তারা জানে ঝুঁকি যতটা না যানে থাকে তারচেয়ে বেশি থাকে আমাদের চিন্তায়, পরিকল্পনায়, দূরদর্শিতায়। ব্যাটারি চালিত রিক্সা বন্ধ করে এটাই প্রমাণ করে যে কোনো ডিভাইস পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা সরকারের দক্ষতার বাইরে।
যানটির যেসব যান্ত্রিক বিপদ দেখিয়ে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, এমন ত্রুটি রাস্তায় চলাচলকারী অধিকাংশ যানেরই রয়েছে। সরকার সেগুলোর সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচী নিচ্ছে। বাস, ট্রাক ও মোটর বাইক নিয়ে সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্নভাবে ভাবছে। এছাড়া এসব যানের নিরাপত্তা ম্যাকানিজম আজ যে পর্যন্ত এসেছে এ পর্যন্ত তো রাতারাতি আসেনি। যেকোনো আবিষ্কারই পরিবর্তনের দাবি রাখে। এসবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নানা গবেষণা পরীক্ষা নিরিক্ষার মধ্যে দিয়ে এ জায়গায় পৌছেছে। তারপরেও এগুলোর কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে এবং বহু মানুষের প্রাণহানি হয়। কিন্তু এগুলো নিষিদ্ধের দাবী একদিকে যেমন অযৌক্তিক অন্যদিকে অদূরদর্শিতাও। বরং এগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নিয়মকানুন/রেগুলেশান তৈরি ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করার কথাটাই যুক্তিযুক্ত।
ব্যাটারি চালিত রিক্সা ভ্যানের ক্ষেত্রেও তাই হবার দাবি রাখে। এগুলোকে নিরাপদ করা, লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট স্থানে চার্জিং এর ব্যবস্থা করাই হলো যুক্তিসঙ্গত। এ কথা কি নীতি নির্ধারকেরা জানে না? তবে কেন এগুলো নিষিদ্ধ করা হচ্ছে? এমন নিষিদ্ধের কবল থাকলে আজ আমাদের হাতে হাতে, বাড়িতে বাড়িতে, চলতে ফিরতে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করি এবং যেসবের কারণে আজ বিশ্বকে প্রযুক্তিগত বিশ্ব বলা হয়, সেসবও তো নিষিদ্ধের দাবী রাখে। এদেরও তো কোনো না কোনো ক্ষতিকর দিক রয়েছে!
আর দুর্ঘটনার যে কারণ দেখিয়েছে তাও প্রবল আপত্তিযোগ্য। ব্যাটারি চালিত রিক্সা ভ্যানের চেয়ে দেশে অন্যসব যানে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয় মোটর বাইক। ব্যাটারি চালিত যানের নাম তলানিতে। কিন্তু কই, অন্যসব যানবাহন তো দুর্ঘটনা ঘটার কারণ দেখিয়ে বন্ধ করা হচ্ছে না। বরং দুর্ঘটনা কীভাবে হ্রাস করা যায় ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন কর্ম পদ্ধতি নিচ্ছে এবং এই নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ব্যাটারি চালিত যানের ক্ষেত্রে নয় কেন?
যে শ্রেণিটা ব্যাটারি চালিত যান চালায় বলে উপরে উল্লেখ করেছি, আসলে তারা এবং তাদের জীবন জীবিকা যেন সরকারের ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। কীভাবে ধরবে? সরকারের চোখ ধনীদের ব্যতিত অন্যদের দেখার জো কই! আর এই ধনীদের দেখে বলেই তো দেশ উন্নয়নশীলে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে, সরকার উন্নয়নের নামে ঢোল বাজানোর আরেকটি ঢোল পেয়েছে। সেখানে হতচ্ছাড়া দরিদ্ররা কেন বিরক্ত করে?
করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। মহামারিতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে ওঠার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউনে গিয়েছিল প্রায় প্রতিটি দেশ।( এখনো চলছে। সামনেও অপেক্ষা করছে করোনার তৃতীয় ঢেউ যার ফলে লকডাউন চলতে পারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত)। ফলে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেখানে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ বাস করে, বাংলাদেশিদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
করোনা মহামারি সংক্রমণের দেড় বছর পার হয়েছে কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে এবং সঞ্চয় হারিয়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখনো দৈনন্দিন জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। আয় কমে যাওয়ায় দেশের ৮০ ভাগ দরিদ্র পরিবার তাদের নিত্যদিনের খাবার খরচ কমিয়ে ব্যয়ের সমন্বয় করছেন। যেভাবে দরিদ্র পরিবারগুলো খাদ্য খরচ কমাচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে পুষ্টিহীনতা বাড়তে পারে। এছাড়া ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ৬০ শতাংশ পরিবার। এমন অবস্থায় কোন যুক্তিতে সরকার দরিদ্র এক শ্রেণিকে পথে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়? তাদের এমন চরম ও নিষ্ঠুর মনোভাবের পেছনে আসলে কি ধরনের মানসিকতা কাজ করে? করোনাকালীন কাজের এই সংকটে তারা কোথায় কাজ খুঁজবে? যারা সুদে কিংবা অন্যকোনো উপায়ে কিংবা ধারের টাকায় ৭০ কি ৮০ হাজার টাকা খরচ করে রিক্সা কিনেছে, আর এটাকেই একমাত্র অবলম্বন হিসাবে দেখে আসছে, তাদের কী হবে? তাদের পরিবারের কী হবে? সরকার কি রাখে গ্রামের কর্মসংস্থানের খবর? কীইবা খবর মফস্বলের?
সরকারের নতুন বাজেট ঘোষণায় দেশে যারা নতুন দরিদ্র হয়েছে তাদের কথা ভাবা হয়নি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে নতুন দরিদ্র হওয়ার বিষয়টিই তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। সে তারা করতেই পারে। আমরাও জানি দেশে নতুন দরিদ্র হওয়ার পেছনে কেবল করোনা মহামারিই নয়, সরকারের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন দুর্নীতি এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে করোনাভাইরাসটি দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে। নতুন দরিদ্রদের অস্বীকার করা সরকার দেশের দরিদ্রদের নিয়ে আর কতটা ভাবিত হবে? তারা তাদের মাথায়ই তেল দিয়ে যাচ্ছে, যাদের মাথাতেই রয়েছে তেলের খনি। আর এ কারণেই শহরে কুকুরের বাচ্চার মত বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতি ও চুরির টাকায় কেনা প্রাইভেট কারের দিকে কারো আঙ্গুল ওঠে না, আঙ্গুল ওঠে রিক্সা ও সিএনজির বিরুদ্ধে। সরকারের ধনী রক্ষা কর্মসূচীরই অংশ এসব।
ফলে রিক্সা হারিয়ে যে মানুষটি দিশেহারা হয়ে পড়বে, সমাজে রাষ্ট্রে আবারও বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বাড়বে, এসব দেখার জন্য সরকারের দৃষ্টি কমই নিক্ষিপ্ত হবে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২০৪১
আপনার মতামত জানানঃ