সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কমপক্ষে ১৭ লাখ। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান। বাকি ৭ লাখ ইজিবাইক। আর ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রিকশা বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা সৃষ্টির জন্য হাইকোর্ট এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপরেও নিষিদ্ধ এ যানগুলো চলছে চোরাই বিদ্যুতের চার্জ দিয়ে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব অবৈজ্ঞানিক বাহন নিষিদ্ধে দাবি জানিয়ে আসছিল পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা। অথচ নিষিদ্ধ না করে উল্টো এসব যানকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক নিরাপত্তায় ইজিবাইক-থ্রি-হুইলার জাতীয় অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে যাচ্ছে সরকার।
বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৮তম সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কথা জানান। তিনি তার সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত হন।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, দেশে চলমান ইজিবাইকগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক যান নয়। দেশের তৈরী অবৈজ্ঞানিক যান বলে এগুলোর ব্রেকের সিস্টেম ভালো নয়। এ কারণে ব্রেক করলে উল্টে যায়। যেখানে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য এগুলোকে রেজিস্ট্রেশনের নামে বৈধতা দেয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশন দিতে হলে সরকার ইনট্যাক (সিবিইউ) বাইক আমাদানি করুক। এগুলোকে বৈধতা দিলে সড়কের বিশৃঙ্খলা তথা দুর্ঘটনা আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণত ইজিবাইক সরাসরি কেউ আমদানী করে না। খুচরা যন্ত্রাংশ (সিকেটি) আমদানী করে পরে বডি তৈরী করে রাস্তায় নামানো হয়। তিনি বলেন, সারাদেশের বিভাগীয় শহর, ৬৪ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে গ্রামে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এসব যানবাহন নেই। এগুলো যারা চালায় তাদের গাড়ি বা বাইক চালানোর মতো সামান্যতমও কোনো জ্ঞান বা ধারণা নেই। সে কারণেও সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
মন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা বলেছেন, ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশন দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। তাতে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানীও বাড়বে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইনকিলাবকে বলেন, বহু কষ্টের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সরকার গ্রামগঞ্জের মানুষের কথা চিন্তা করে ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশন দিলে দিতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে কখনওই মহাসড়ক, মহানগর বা সিটি করপোরেশনে বৈধতা দেয়া যাবে না। তাহলে সড়কের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির মানুষ রিকশায় বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহারের মাধ্যমে ইঞ্জিনবিহীন হালকা যানবাহন হিসেবে রাস্তায় নামায়। সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানী। এর আগে ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলোতে স্যালো মেশিনের ইঞ্জিন দিয়ে নসিমন, ভটভটি, চাঁন্দের গাড়ি ইত্যাদি চলাচল শুরু করে। ২০১৭ সালে যখন আইন করে মহাসড়কে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক । এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পুলিশকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞাই কার্যকর হয়নি। সিন্ডিকেটের কারণে বরাবরই ভেস্তে গেছে সরকারের উদ্যোগ।
এদিকে এসব অটোরিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘লাইনম্যান’। একইভাবে লাইনম্যানের দেখা মিলবে ইজিবাইক স্ট্যান্ডগুলোতেও। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে অটোরিকশা ও ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে লাইনম্যানরা মূলত বেতনভূক্ত। এসব যান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। চাঁদার একটা বড় অংশ পায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ‘লাইন খরচ’ নামে প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন লাইনম্যানরা।
আবার লাইনচার্জের বাইরে অঘোষিত অনুমোদন নিতে হয় অটোরিকশাকে। অনুমোদন হিসেবে একটি চক্র ভিজিটিং কার্ডের আকারের একটি কার্ডে সরবরাহ করে থাকে রিকশা মালিকদের। প্রতি মাসের জন্য একটি করে কার্ড নিতে হয় রিকশামালিকদের। আর এই কার্ডের বিপরীতে খরচ গুণতে হয় এলাকাভেদে হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত। এদিকে অনুমোদনহীন মোটরযুক্ত পরিবহনগুলোর কারণে সড়কে দুর্ঘটনার ঘটনাও নিয়মিত। দ্রুতগতিসম্পন্ন এই পরিবহণের পেছনে খরচ হচ্ছে বিপুল বিদ্যুৎ।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী বলেন, ঢাকা মহানগরে যদি এক লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে তবে সেগুলোতে ৪ লাখ ব্যাটারি আছে। এর মধ্যে মাসে ৪০/৫০ হাজার ব্যাটারি নষ্ট হচ্ছে। ৫০ হাজার ব্যাটারি ক্রাশ করার মতো কোনো জায়গা কিন্তু নেই। এগুলো যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। তাতে ব্যাটারির এসিড পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার আগে এগুলোকে সংস্কার করতে হবে। সংস্কার ছাড়া এগুলোকে বৈধতা দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। কোনোভাবেই এগুলোকে মহাসড়ক ও মহানগরে চলতে দেয়া যাবে না। পরিবেশ বাঁচাও, ব্যাটারিচালিত যানগুলো পরিবেশের জন্য সরাসরি ক্ষতিকর। সঠিকভাবে এগুলোর ব্যাটারি রিচার্জ করা হয় না বলে সরকারের বাজেটে একটা বিরুপ প্রভাব পড়ে। এজন্য সরকারের উচিত এগুলো বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
এসডব্লিউ/আইকিউ/ এফএ/১৫৪৮
আপনার মতামত জানানঃ