পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক অদ্ভুত দ্বৈরথ এখন চরমে। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একদিকে দুর্নীতি, হুমকি ও জমি দখলের অভিযোগ পুঞ্জীভূত হলেও, বিজেপির হিন্দি-হিন্দুত্ব কেন্দ্রিক আগ্রাসী রাজনীতির কারণে জনমানসে তৃণমূল আবারও জায়গা করে নিচ্ছে। কলকাতার এক নামকরা প্রকাশকের অভিযোগ অনুযায়ী, তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত নেতার চাপে তাঁদের বহু পুরনো দোকান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। প্রশাসনের কাছে গেলে তারাও নেতার সঙ্গে মিটমাটের পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ জানে, মমতার দল ক্ষমতার অপব্যবহার করছে—তবু ভোট দেওয়ার সময় সেই তৃণমূলকেই তারা বেছে নেবে।
এর পেছনে মূল কারণ বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল। হিন্দি ভাষা ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিকে জোরপূর্বক দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এখন প্রত্যাঘাত সৃষ্টি করছে। বিজেপি গত এক দশকে সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দি ভাষার প্রসারে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছে এবং এগুলোকে রাষ্ট্রের মূল ভাষা ও সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এর ফলে তামিল, মারাঠি, কন্নড়, এমনকি বাংলা জাতীয়তাবাদ জেগে উঠছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই আঞ্চলিক চেতনার জোয়ারে নতুন করে শক্তি পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
বিজেপি হয়তো ভেবেছে হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলোর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে লোকসভায় তাদের আসন ও প্রভাব বাড়বে। ফলে তারা হিন্দি ও উত্তর ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে বিপুল হারে শ্রমিক দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় জনবিন্যাসও পাল্টে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এর ফলাফল হিসেবে অবাঙালি ভোট বেড়েছে, এবং বিজেপি জানে, এদের অধিকাংশ তাদের দিকে থাকবে। কিন্তু এই বাস্তবতা স্থানীয় বাঙালি ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও যদি বহিরাগতদের হাতে চলে যায়, তাহলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।
এই আতঙ্ককে কাজে লাগিয়েছে তৃণমূল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কার পর থেকেই ‘বাঙালি বনাম বহিরাগত’ স্লোগান চালু করে তারা কার্যত বিজেপির ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ মেরুকরণ কৌশলের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বহিরাগত বলতে মূলত বিহার, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থান থেকে আগত হিন্দিভাষী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের বোঝানো হচ্ছে। বিজেপিকে তারা বাংলার বাইরে থেকে আসা এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছে।
এই পরিস্থিতিকে আরও অনুকূল করেছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে বিতাড়ন এবং বাংলাদেশে পাঠানোর মতো কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলো। আবার বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাল সময়ের পর দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোর সম্পর্কও স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে, যা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভোটারদের মধ্যে জাতিগত নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, মুসলিম সমাজের এক বড় অংশ তৃণমূলের ওপরে অসন্তুষ্ট হলেও কংগ্রেস বা বামপন্থীদের ভোট দিতে ভয় পাচ্ছে। কারণ, তাদের আশঙ্কা, তাতে বিজেপির সুবিধা হবে। মুসলিমরা এখন রাজনীতিতে কৌশলী ভোটদানে অভ্যস্ত, এবং বিজেপিকে ঠেকানোই তাদের কাছে প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ ভোট মুসলমানদের, তাই এই ভোট যেদিকে যাবে, ফলাফল অনেকটাই সেই দিকেই ঝুঁকবে।
তবে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু বাঙালিদের মধ্যেও একটি বড় অংশ তৃণমূলের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরক্ত। কিন্তু তবুও তারা বিজেপিকে ভোট দিতে রাজি নন। কারণ, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন—বাংলার রাজনীতি যদি পুরোপুরি হিন্দিভাষীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে বাঙালির অস্তিত্বের জায়গাটাই বিলীন হয়ে যাবে। কলকাতা বা দীঘার ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই ভয় ব্যাপক। সেই ভয় থেকেই গড়ে উঠছে নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনা।
এই নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিচ্ছে তৃণমূলকে। রাজনৈতিক মঞ্চের বাইরেও এই চেতনার বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘বাংলা পক্ষ’ নামক সংগঠন গত কয়েক বছরে জেলায় জেলায় শাখা গড়ে তুলেছে, যাদের বক্তব্য ‘বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা ও অধিকার রক্ষা করা’। এসব সংগঠন রাজনৈতিক দলের মতো নির্বাচন করে না, তবে জনমত গঠনে তাদের ভূমিকা বাড়ছে। ফলে ভবিষ্যতে তৃণমূল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের দুর্নীতি বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা ভোটের ময়দানে আর তেমন প্রভাব ফেলবে না। বরং বিজেপির ‘হিন্দি-হিন্দুত্ব’ কৌশলই শেষ পর্যন্ত তৃণমূলকে পরোক্ষভাবে সুবিধা দেবে। যারা বিজেপিকে ঠেকাতে চায়, তাদের পছন্দের একমাত্র বিকল্প হবে তৃণমূল। এই বাস্তবতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন এবং সেই মোতাবেক রাজনৈতিক কার্ড খেলছেন।
পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচন তাই শুধুই দলীয় প্রতিযোগিতা নয়, এটি হয়ে উঠছে আঞ্চলিক পরিচয়ের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আর এই লড়াইয়ে যে দল সেই পরিচয়ের সুরক্ষা দিতে পারবে বলে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছে, জয় তার পক্ষেই যাবে—এবং বর্তমানে সেই দল তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি নিজেরই রণনীতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে জেতার রসদ যোগাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ