নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সফরগুলো—সাইপ্রাস, কানাডা ও ক্রোয়েশিয়া—যদিও পরিকল্পিত ছিল দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে, সফরের আগেই যেন তার কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ উল্টে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাধিক মন্তব্যে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থামানো নিয়ে ট্রাম্পের প্রকাশ্য কৃতিত্ব দাবি ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ—সবমিলিয়ে মোদি সরকারের জন্য পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে বেশ বিব্রতকর।
ট্রাম্প তাঁর পুরোনো অভ্যাসমতো নিজেকে সামনে এনে বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তিনি নিজেই থামিয়েছেন। বিষয়টি যেমন মোদির জন্য বিড়ম্বনার, তেমনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দীর্ঘদিনের অবস্থানেরও এক বিপরীত সুর। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের চিরায়ত নীতি হলো—তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা না মেনে, সবকিছুই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। কিন্তু ট্রাম্পের বক্তব্যে সেই ধারণার ওপর সরাসরি আঘাত এসেছে। তার ওপর পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র যেভাবে মোদি-ট্রাম্প ফোনালাপ নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আর ট্রাম্প যেভাবে তা প্রকাশ্যে খণ্ডন করেছেন—তাতে ভারত সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো ট্রাম্পের আচরণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে কিছু সময়ের জন্য দেখা করার প্রস্তাব দিলেও মোদি তা সময়ের অভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু সেই ফাঁকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে সম্মানজনক আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প এবং বলেন, তিনি যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব মুনিরকেও দিতে চান। এই ঘটনাকে ভারতীয় মিডিয়ায় দেখা হচ্ছে মোদির কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে, আর বিরোধী দলগুলোর জন্য এটি যেন অজেয় এক সুযোগ।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এটি তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ, তৃণমূল সংসদ সদস্য সাকেত গোখলের মতো নেতারা সরাসরি মোদি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘যে আসিম মুনির পেহেলগাম ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করলেন ট্রাম্প—এটি ভারতীয় কূটনীতির চরম অপমান’, বলেছে বিরোধীরা। মোদির নীরবতা এই সমালোচনাকে আরও বেশি করে জোরদার করেছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের দীর্ঘদিনের চেষ্টা ছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশটিকে একঘরে করে ফেলা। বিশেষ করে এফএটিএফের ধূসর তালিকায় দীর্ঘসময় ধরে পাকিস্তানকে রাখার জন্য ভারত পরিশ্রম করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান সেই তালিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণও আদায় করতে পেরেছে। ভারতের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র’ প্রমাণ করা যায়নি। এমনকি ট্রাম্পের চোখে ভারত-পাকিস্তান সমান গুরুত্ব পেয়েছে—এটি ভারতের জন্য অস্বস্তিকর বাস্তবতা।
ট্রাম্পের পাকিস্তানপ্রীতির পেছনে আরেকটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে—মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি। ইসরায়েল–ইরান যুদ্ধ যদি সরাসরি আকার নেয়, তাহলে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবারও অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই হয়তো ট্রাম্প এখন পাকিস্তানকে তুষ্ট রাখতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে ভারতকে সেকেন্ড লাইন পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করার ঝুঁকি থেকে যায়।
তবে এসব কূটনৈতিক চাপ ও জটিলতার মধ্যেও মোদির কিছু অর্জন রয়েছে। কানাডার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে জমাট বাধা পড়েছিল, তা কিছুটা হলেও আলগা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে মোদি সেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দীর্ঘ ২০ মাস পর দুই দেশ আবার হাইকমিশনার নিয়োগে রাজি হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তা।
তবে তাতেও মোদি এখনো নিজেকে সমালোচনা থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। ট্রাম্পের মন্তব্য ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ঘিরে প্রকাশ্য কূটনৈতিক কৌশলের কারণে ভারত সরকারের গ্রহণযোগ্যতা, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শক্তি ও নিজস্ব অবস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে মোদি নিজেই যখন অতীতে ভারতের দৃঢ় অবস্থান ও কাশ্মীর প্রশ্নে আগ্রাসী মনোভাবের প্রবক্তা ছিলেন, তখন তাঁর বর্তমান অবস্থানকে বিরোধীরা তুলে ধরছে আত্মবিরোধী হিসেবে।
সর্বশেষ প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে—যদি ট্রাম্পের দাবি সত্যই না হয়, তাহলে মোদি কেন তীব্রভাবে তা অস্বীকার করছেন না? আর যদি ট্রাম্পের দাবির মধ্যে সত্যের কিছু থেকে থাকে, তাহলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও দীর্ঘদিনের অবস্থান নিয়ে যে আত্মঘাতী প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তার দায় কে নেবে?
এই পরিস্থিতিতে মোদি সরকারের সামনে কূটনৈতিকভাবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা, অন্যদিকে পাকিস্তানকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই মোকাবেলা করা। তবে ট্রাম্প যেভাবে পাকিস্তানকেও ‘বন্ধু’ এবং ‘সম্মানিত’ বলছেন, তাতে স্পষ্ট যে মোদির কূটনীতি এখন সংকটে। আর সেই সংকট শুধু আন্তর্জাতিক মহলে নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও মোদিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাই বলা যায়, সাম্প্রতিক সফর ও ট্রাম্পের বক্তব্য ভারতের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনি মোদির কূটনৈতিক ব্যর্থতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
আপনার মতামত জানানঃ