
নকল কখনও আসলকে টেক্কা দিতে পারে না। এমনটাই বলেন সকলে। কিন্তু সব সময়ই কি তা হয়? অন্তত চীনের ‘কৃত্রিম সূর্য’ সেই ধারণাকে যে চুরমার করে দিয়েছে তা বলাই যায়। সূর্যের কেন্দ্রের উষ্ণতা যেখানে দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে চীনের এই ‘কৃত্রিম সূর্য’ উৎপন্ন করতে পেরেছে ৭ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস! অর্থাৎ সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার ৫ গুণ! তবে তা ১৮ মিনিটের জন্য। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এই সাফল্য চমকে দিয়েছে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এতে নিউক্লিয়ার ফিউশন বা কেন্দ্রকীয় সংযোজন প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব বিপুল শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। অন্তত সে পথে এক ধাপ এগিয়ে নেবে।
নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় একাধিক হালকা নিউক্লিয়াই সংযোজিত হয়ে তুলনামূলক ভারী নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় বিপুল শক্তি। মূলত সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশনের প্রক্রিয়া অনুকরণ করছেন ওই বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের অনেক দেশই ফিউশন রিঅ্যাকটর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তবে এ প্রযুক্তিতে এবার উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে চীন। দেশটির বানানো নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকটর ডিভাইস সূর্যের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি তাপমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বিজিআরের প্রতিবেদনে জানা যায়, রিঅ্যাকটরটি ৭ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে এই তাপমাত্রা প্রায় ১৮ মিনিট পর্যন্ত ধরে রাখে।
আপাতদৃষ্টিতে ১৮ মিনিটকে খুব কম সময় মনে হতে পারে। কিন্তু যখন এটি সূর্যের থেকেও পাঁচ গুণ বেশি তাপমাত্রা ধরে রাখার মতো ব্যাপার তখন ১৮ মিনিটই খুব দীর্ঘ সময়।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সূর্যের রেপ্লিকা হিসেবে তৈরি করা এ কৃত্রিম সূর্যে হাইড্রোজেনকে সবুজ শক্তি বা বিদ্যুতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চালানো হবে। এখান থেকে উৎপন্ন উত্তাপ নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি।
তারা জানান, শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফিশন প্রক্রিয়ার তুলনায় ফিউশন প্রক্রিয়া ভিন্নভাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে বস্তুর নিউক্লিয়াসকে পৃথক না করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। এই ফিউশন প্রক্রিয়া সুলভমূল্যের অফুরন্ত শক্তি উৎপাদনের পথ খুলে দেবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। আর তা ফিশন প্রক্রিয়ার চেয়ে পরিবেশবান্ধব, যাতে ক্ষতিকর নিউক্লিয়ার বর্জ্যও উৎপন্ন হবে না।
বিশ্বের অনেক দেশই ফিউশন রিঅ্যাকটর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তবে এ প্রযুক্তিতে এবার উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে চীন। দেশটির বানানো নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকটর ডিভাইস সূর্যের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি তাপমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, বিশ্বে প্রথম কার্যকর নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকটর তৈরিতে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে সফলতা পেলে হাজারও কোটি টাকা মূল্যের পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ও শক্তি উৎপাদন সম্ভব হবে। তারা বলছেন, এতে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা থেকে পৃথিবীকে অনেকটাই রক্ষা করা সম্ভব হবে। চীনের হফেই ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্যাল সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা তাদের এই কৃত্রিম সূর্য নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন কয়েক বছর ধরে।
শিনহুয়া নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়েছে, চীনের আনহুই প্রদেশের হফেই শহরের ‘এক্সপেরিমেন্টাল অ্যাডভান্সড সুপারকন্ডাক্টিং টকামাক (ইএএসটি)’ নামের নিউক্লীয় ফিউশন চুল্লিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত গবেষকেরা। হফেই ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্যাল সায়েন্সের অংশ এটি। এখন চুল্লিটিকে আরও শক্তপোক্ত, আরও তাপসহনীয় করার চেষ্টা করছেন তারা।
এ ধরনের গবেষণাগারকে কৃত্রিম সূর্য বলার কারণ সেখানে মূল সূর্যের নিউক্লীয় ফিউশনের প্রক্রিয়া অনুকরণ করা হয়। অর্থাৎ সূর্যের শক্তি উৎপন্নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। এমন বিক্রিয়ায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজেন ও ডিউটেরিয়াম গ্যাস।
এর মূল লক্ষ্য বলা যায় মানুষের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার পরিবেশবান্ধব উৎস তৈরি। সমুদ্রের এক লিটার পানি থেকে যে পরিমাণ ডিউটেরিয়াম গ্যাস পাওয়া যাবে, তা থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে পাওয়া শক্তি ৩০০ লিটার গ্যাসোলিন পুড়িয়ে পাওয়া শক্তির প্রায় সমান।
ইএএসটি গবেষণাগারটি চীনাদের তৈরি হলেও ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের নানা দেশের বিজ্ঞানীরা সেখানে গবেষণা করেন। ১০ হাজারের বেশি চীনা এবং বিদেশি বিজ্ঞানীর কাজের ফল এই কৃত্রিম সূর্য। এ প্রকল্পে চীন এরই মধ্যে ৭০ কোটি ১০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড খরচ করেছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দ্য সান। গত ডিসেম্বরের শুরুতে শুরু হওয়া পরীক্ষণটি চলবে আগামী জুন পর্যন্ত।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষকেরা ‘কৃত্রিম সূর্য’ ৭ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ১৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড পর্যন্ত পরিচালনা করেন। অথচ মূল সূর্যের কেন্দ্র দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উত্তপ্ত হতে পারে।
চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব প্লাজমা ফিজিকসের পরিচালক সং ইয়ুনতাওয়ের ভাষায়, গবেষণা থেকে প্রায়োগিক পর্যায়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার মাইলফলক এটি।
গত মে মাসে ইএএসটি আরেকটি মাইলফলক অর্জন করে। সেবার ১২ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে চুল্লিটি ১০১ সেকেন্ড ধরে চলেছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ