অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম। করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করছে করোনা প্রতিরোধী টিকাগুলো। শুরুতে এক আর দুই ডোজের টিকার প্রাধান্য দেয়া হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এখন বুস্টার ডোজের কথা ভাবছে সংস্থাগুলো। এমনিতেই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশ পিছিয়ে। আবার টিকাদান কার্যক্রমও ধীরগতিতে চলছে এই দেশগুলোতে। এভাবে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। টিকা বৈষম্যের কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্যবধানও আরও বাড়বে। দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
করোনা সংক্রমণ শুরুর পর খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে টিকা। মহামারির এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই টিকাদান শুরু করে উন্নত দেশগুলো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় চলে এসেছে। কিন্তু সব দেশে টিকাদানের গতি এক নয়। এ কারণেই টিকাদানে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তবে বেশি সংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিতে না পারার কারণে সারা বিশ্বের আর্থিক যে ক্ষতি হবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়া মহাদেশ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ মহাদেশের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে জিডিপির বিবেচনায় হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের, ২০২২-২৫ সালে জিডিপির ৩ শতাংশ।
করোনার টিকাদানে ধীরগতির কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে যেসব দেশ ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারবে না, চার বছরে সেসব দেশের সম্মিলিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৯ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা (১৯.৭৮ ট্রিলিয়ন)। এ অর্থ ফ্রান্সের এক বছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির সমান। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির দুই তৃতীয়াংশ হবে বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোর।
এদিকে, আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটার তথ্যানুসারে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেখানে ৯৪ শতাংশ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন, সেখানে তানজানিয়ায় টিকা পেয়েছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ মানুষ। নাইজেরিয়ায় টিকা পেয়েছেন ২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ও ইথিওপিয়ায় টিকা পেয়েছেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ।
তবে বেশি সংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিতে না পারার কারণে সারা বিশ্বের আর্থিক যে ক্ষতি হবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়া মহাদেশ।
দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অর্থনৈতিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে দেখিয়েছে, যেসব দেশ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৬০ শতাংশের কম মানুষকে টিকা দেবে, ২০২২-২৫ সালের মধ্যে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার।
ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে টিকা প্রাপ্তির এই ব্যবধান কখনো ঘুচবে বলে মনে করার বিশেষ কারণ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গঠিত কোভ্যাক্সের মাধ্যমে গরিব দেশগুলো টিকা পাবে এমন আশা সৃষ্টি হয়েছিল, পরিমাণে কম হলেও। কিন্তু সেই আশাও তারা পূরণ করতে পারেনি। এই কোভ্যাক্স থেকে উন্নত দেশগুলোর এ বছর ১৯০ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত কোভ্যাক্স থেকে বিশ্বের সব দেশকে যে টিকা সরবরাহ করা হয়েছে, তা দিয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে।
যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো উন্নত দেশও কোভ্যাক্সের কাছ থেকে টিকা নিচ্ছে। গত জুন মাসে যুক্তরাজ্য কোভ্যাক্সের কাছ থেকে ৫ লাখ ৩৯ হাজার ডোজ টিকা নিয়েছে। সেই মাসে আফ্রিকা অর্ধেকের মতো কোভ্যাক্সের টিকা পেয়েছে। এতে কোভ্যাক্স আরও চাপের মুখে পড়েছে।
ধনী দেশগুলো এত দিন কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছে। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, তারা কত টিকা দেবে। কিন্তু সেই অঙ্গীকারও তারা রাখতে পারেনি। ২০২২ সালের মধ্যভাগের মধ্যে যুক্তরাজ্য যে ১০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, তার মাত্র ১০ শতাংশ এখন পর্যন্ত দিয়েছে।
এই বাস্তবতায় গরিব দেশগুলোর টিকা পাওয়ার আশা আরও কমে যাচ্ছে; কারণ, উন্নত দেশগুলোর এখন শিশুদের টিকা দেওয়া শুরু করেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এর আগের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করেছে ইআইইউ।
এএফপি জানায়, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষতির মুখে পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। ইতিমধ্যে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে। যেখানে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অপ্রতুল রয়ে গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশ ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ টিকা দিতে ব্যর্থ হবে তারা ২০২২-২৫ মেয়াদে ২ ট্রিলিয়ন ইউরোর সমান ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইআইইউ বলেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এই ক্ষতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বহন করবে এবং উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক দূরত্ব বেড়ে যাবে।
তারা সতর্ক করেছে, টিকা বিলম্বিত হওয়ায় অসন্তোষ বাড়তে পারে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়বে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা প্রায় মোট ক্ষতির তিন-চতুর্থাংশ।
ওদিকে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকার সুষম বণ্টন না হলে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হলে বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃত্যুহার আরও বাড়বে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য এখনো করোনার টিকার প্রথম ডোজই নিশ্চিত করতে পারেনি। এজন্য বুস্টার ডোজ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯ টিকা বিক্রি করে ২০২৩ সালে ফাইজার ও বায়োএনটেক ৬৬০ কোটি ডলার ও মডার্না ৭৬০ কোটি ডলার আয় করবে। এ আয়ের বেশির ভাগই আসবে টিকার বুস্টার ডোজ থেকে। এরপর এ টিকার বার্ষিক বাজার হবে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের বেশি। মার্কিন সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ফ্লু টিকার প্রতি ডোজের দাম ১৮-২৫ ডলার। চলতি বছর টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো ৪ থেকে ৫ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে ফ্লু টিকার। আর ফাইজার যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ ডলার ৫০ সেন্ট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৯ ইউরো ৫০ সেন্ট মূল্যে প্রতি ডোজ করোনা টিকা সরবরাহ করছে।
বলা হচ্ছে যে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড টিকা তৈরি ও সরবরাহ করছে, তারা অতি মুনাফা না করলে মানুষ হয়তো পাঁচ ভাগের একভাগ দামে টিকা পেতো।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সাধারণ মানুষের টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে না। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো কোটি ডলার কামানোর ধান্দায় রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিতে পারে, জীবন বাঁচাতে পরে সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে অন্য খাতের গুরুত্ব কমিয়ে টিকাদান কার্যক্রমকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ