আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রাম বা ইউসেপ বাংলাদেশ এনজিওটির লক্ষ্য দরিদ্র ও কর্মজীবী শিশুকিশোরদের সাধারণ শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রশিক্ষণপ্রদান এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে অনুদানের মাধ্যমে। যেখানে বিদেশী দাতা সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদানই সবচেয়ে বেশি। তবে সম্প্রতি বেশকিছু উন্নয়নশীল দেশের সহযোগী দাতা সংস্থা অনুদান বন্ধ করা দেয়ায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে কর্তৃপক্ষ।
১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূল দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন এলাকার মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিউজিল্যান্ড থেকে লিন্ডসে অ্যালেন চেইনী নামে একজন সেবাকর্মী একটি ব্রিটিশ ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে এ দেশে আসেন। ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি গৃহহীন ও দরিদ্র শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ডেনমার্ক সরকার আর্থিক সহায়তাসহ একটি তিনবছর মেয়াদি প্রকল্প অনুমোদন করে। শুরুর দিকে ইউসেপ কমিউনিটি স্কুলের মডেল অনুযায়ী দরিদ্র ও কর্মজীবী শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
স্কুলবহির্ভূত দরিদ্র শিশুদের জন্য ইউসেপ মডেল সমাদৃত হয়। ইউসেপ ১৯৮৩ সালে সাধারণ শিক্ষাদান কর্মসূচির সাথে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে এবং এ লক্ষ্যে ঢাকায় একটি কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই সময়ের মধ্যে ইউসেপের শিক্ষা কার্যক্রম চট্টগ্রাম এবং খুলনা শহরে সম্প্রসারিত হয়। সমাজকল্যাণ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর অধীনে ১৯৯০ সালে ইউসেপ একটি জাতীয় এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের সফলতা বেশ উল্লেখযোগ্য এখন অব্দি। কেবল ২০১৯ সালেই ইউসেপের ১০ হাজার ৩৬০ শিক্ষার্থী ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। ওই বছর ৪ হাজার ৮৬৯ জন জেএসসিতে, ৩২১ জন এসএসসি ভোকেশনাল ও ৯৪ জন এসএসসি (সাধারণ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি জেলায় ৫৩টি সাধারণ শিক্ষা ও ১০টি কারিগরি শিক্ষা বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৩২টি সাধারণ স্কুল, ১৭টি টেকনিক্যাল আউটরিচ সেন্টার, দুটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১০টি রিকগনিশন অব প্রায়োর লার্নিং সেন্টার (আরপিএল) ও পাঁচটি ভোকেশনাল স্কুলে এসএসসি ভোকেশনাল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানটি বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ইউসেপ বাংলাদেশের চেয়ারপারসন পারভীন মাহমুদ।
তিনি এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ পায় না কিংবা স্কুল থেকে কোনো কারণে ঝরে গেছে, মূলত তাদেরই আমরা শিক্ষার সুযোগ করে দিই। আমরা সরকারের উন্নয়ন যাত্রাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি। সরকারের আন্তর্জাতিক যেসব লক্ষ্য রয়েছে, সেগুলো অর্জনে ইউসেপ বাংলাদেশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিদেশী সহায়তা এত দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। তাই আপাতত নতুন কোনো কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছি না। এখন টিকে থাকার লড়াই করছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে নতুন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রয়োজন। নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প যতগুলো সম্ভাব্য উৎস রয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি জেলায় ৫৩টি সাধারণ শিক্ষা ও ১০টি কারিগরি শিক্ষা বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৩২টি সাধারণ স্কুল, ১৭টি টেকনিক্যাল আউটরিচ সেন্টার, দুটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১০টি রিকগনিশন অব প্রায়োর লার্নিং সেন্টার (আরপিএল) ও পাঁচটি ভোকেশনাল স্কুলে এসএসসি ভোকেশনাল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
ইউসেপ বাংলাদেশের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তাদের মোট আয় ছিল ১১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যার মধ্যে প্রায় ১০২ কোটি টাকা এসেছিল অনুদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ মোট আয়ের প্রায় ৮৮ শতাংশই ছিল অনুদাননির্ভর। অন্যদিকে ২০১৯ সালে মোট আয় ছিল ৯২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৮৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বা মোট আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল অনুদানের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশী সাহায্য বন্ধ হলে আর্থিকভাবে চাপ তৈরি হবে প্রতিষ্ঠানটিতে। যার ফলাফল হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
ইউসেপ বাংলাদেশ আয়োজিত ‘মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং ইউসেপের গৌরবময় অভিযাত্রা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সরকারের সঙ্গে কীভাবে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘শুরুতে নানা নীতিমালার কথা বলে ডোনার সাহেবরা মাঝপথে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যান। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। মাঝপথে ভাসিয়ে দিয়ে যদি ডোনার আমাদের থেকে বিদায় নেন, তাহলেও সেই কাজ আমরা শেষ করতে পারব। আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে সেটি চালাতে পারব। আমাদের শক্তি আছে, আমরা আর সহায়তা চাই না।’
বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘বক্তৃতা দিয়ে কোনো সম্পদ সৃষ্টি হয় না। সম্পদ সৃষ্টি করতে হলে কাজ করতে হবে, লোহার ওপর পেটাতে হবে কিংবা নৌকা বাইতে হবে অথবা লাঙল বইতে হবে। লাখ লাখ মানুষ কাজ করছে বলেই সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে। এ সম্পদ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করছেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৭২-২০১০ সালে ইউসেপ শহর এলাকার ১,৭১,০১৬ জন কর্মজীবী দরিদ্র শিশুকে সাহায্য করেছে। এদের মধ্যে ইউসেপের সাধারণ বিদ্যালয় থেকে ৯৫,০২৬ জন ছাত্র ৫ম শ্রেণি এবং ৭১,৫৩৬ ছাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস করেছে। ১৯৮৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ শেষ করেছে ৩৮,৩১৮ জন শিশু। ২০১০ সালে ইউসেপের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রে নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৩৭,০০০। ২০১০ সালের জন্য ইউসেপের বাজেট ২,০৪০,৮৭৩,৬৬ টাকা। এসক্যাপ ইউসেপকে ১৯৯৫ এবং ১৯৯৭ সালে মানবসম্পদ উন্নয়ন সংস্থাসমূহের প্রতিযোগিতায় রানারস আপ ঘোষণা করে।
বিশেজ্ঞদের মত, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের যে আর্থিক অবস্থা, তাতে বিদেশী অনুদান ছাড়া ইউসেপের অধীনে থাকা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন তীব্র আশঙ্কার মুখে। গোটা বিশ্ব যদি করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে না পারে তবে ইউসেপসহ বিদেশী অনুদানে চলা এনজিওর অধীনে থাকা প্রত্যেকেই আরও করুণভাবে অসহায় হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৫৪৭
আপনার মতামত জানানঃ