দেশে এবার ডেঙ্গু ভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর নাম ডেনভি-৩। নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন রাজধানীবাসী। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
রাজধানীর একটি হাসপাতালের ২০ জন রোগীর নমুনা গবেষণা করে শতভাগ এই ভাইরাস শনাক্ত করেছে বিসিএসআইআর। বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ এ তথ্য জানান।
এই নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের হেমোরেজের পাশাপাশি শকে চলে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। জুলাই মাস থেকে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯ হাজারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৪০ জনের বেশি রোগী। এবার ডেঙ্গুর এ ভয়াবহতার পেছনে দায়ী এই ডেনভি-থ্রি ভাইরাস।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, দেশে প্রথম ডেঙ্গুর ডেনভি-৩ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। এর আগে শনাক্ত হওয়া বাকি দুই ধরনের (ডেনভি-১ ও ২) বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে।
প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর আবার ডেঙ্গুর ভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বাড়ে, বলছেন চিকিৎসকরা। এ প্রসঙ্গে ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, ডেনিভি-৩ ডেনভি-১ ও ২ এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। যারা আগে ওয়ান ও টুতে আক্রান্ত হয়েছেন তারা আবার এই ডেনভি-থ্রিতে আক্রান্ত হলে শক ও রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে। এতে রক্ত জমাট বাঁধা, রক্ত ক্ষরণ হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া বা বুকে পানি জমা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
লিখিত বক্তব্যে বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাে. অফিতাব আলী শেখ বলেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরােটাইপ যা ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ এবং ডেনভি-৪ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই ভাইরাসের ৪টি সেরােটাইপের মধ্যে ৬৫-৭০ শতাংশ এমিনাে এসিড সিকোয়েন্সের মিল আছে। ভাইরাসটি এডিস মশা দ্বারা বাহিত হয় এবং মশার মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। ১৯৬০ সালে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
এদিকে, সাম্প্রতিক এই গবেষণা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের গবেষণা ডেঙ্গু চিকিৎসায় সহায়ক হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান বলেন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্স করলে তা চিকিৎসা দেওয়ার কাজে সহায়তা করবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের বিষয়েও গবেষণা করার পরিকল্পনার কথা জানায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ।
গত ২৮ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে আরও ২৬৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নয় হাজার ৫৬৯ জনে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৪ জন ঢাকার এবং ৫১ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত নয় হাজার ৫৬৯ জনের মধ্যে চলতি মাসেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ছয় হাজার ৯১১ জনের। মোট শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে মাত্র ৭২১ জন ঢাকার বাইরের।
গত জুলাই মাসে দুই হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ ছাড়া জুন মাসে ২৭২ জন ও মে মাসে ৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আগস্ট মাসে এখন পর্যন্ত ২৯ জন মারা গেছেন। বর্তমানে রাজধানী বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৬৭ জন ও ঢাকার বাইরে ১৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মশকবাহিত রােগ হলো ডেঙ্গু। বর্তমানে প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ এর সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। ইতােমধ্যে এ রােগটি বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে বিস্তার লাভ করেছে। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় এবং এটি বাংলাদেশে সংক্রমিত রােগের মধ্যে অন্যতম। যদিও বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রােগী চিহ্নিত হয়, তবে ২০০০ সালে প্রথমবারের মতাে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারণ করে।
আইইডিসিআরের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৬ সালের আগে সেরােটাইপ ডেনভি-১ এবং ডেনভি-২ এর মাধ্যমে মহামারি সংঘটিত হয়, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাকি ২টি সেরােটাইপ শনাক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে ডেনভি-৩ প্রথম শনাক্ত হয় এবং ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং ২০১৯ সালে এটি মহামারি আকার ধারণ করে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়। যদিও ২০১৯ সালে ডেঙ্গু ভাইরাসের ১টি মাত্র নমুনার জিনােম সিকোয়েন্স করা হয়, সেখানে সেরােটাইপ-২ শনাক্ত হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৫৬
আপনার মতামত জানানঃ