১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাস; পোলিও উদ্ভ্রান্ত আমেরিকার পাঁচটি পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশে ২ লাখের বেশি শিশুকে একটি পোলিও টিকা দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই টিকার মাধ্যমে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়াটি ত্রুটিযুক্ত ছিল; মূলত টিকার ডোজের মধ্যে ছিল পোলিওর জীবিত ভাইরাস। আর এতেই আজীবন পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয়েছে অসংখ্য শিশুদের।
এই টিকা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত এবং শিশুদের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে। এই ঘটনার একমাসের মধ্যেই পোলিও প্রতিরোধের জন্য গণটিকাকরণ কর্মসূচীও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় আমেরিকার স্বাস্থ্য দপ্তর। মুখ থুবড়ে পড়ে পোলিওর বিরুদ্ধে দেশটির সমস্ত প্রতিরোধ।
এভাবেই টিকা আবিষ্কার আশীর্বাদের বদলে অভিশাপও বয়ে এনেছে পৃথিবীতে; যেমনটি হয়েছিল আমেরিকায় পোলিও টিকা আবিষ্কারের সময়ে; যা দ্য কাটার ইনসিডেন্ট বা কাটার দুর্ঘটনা নামে পরিচিত।
এই ঘটনার তদন্তে উঠে আসে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি পারিবারিক ফার্মের কাটার ল্যাবরেটরির কথা। এই ল্যাবরেটরিতে যে টিকাগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই চল্লিশহাজার শিশুর পোলিও রোগ থেকে মুক্তি না পাওয়ার কারণ ছিল এবং প্রায় দু’শোরও বেশি শিশু এই টিকা নেওয়ার ফলে বরাবরের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং দশজন শিশু মারা যায়।
পারমাণবিক বোমার পর পোলিওকেই আমেরিকাবাসীরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন। ১৯০৮ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের পোলিও ভাইরাস আবিষ্কারের দশ বছরের মধ্যেই নিউইয়র্কের মহামারীতে প্রায় চব্বিশশো মানুষ মারা যান যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু। এছাড়াও হাজারেরও বেশি শিশু আজীবন পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছিল। এরপর ১৯৫০ সালে গ্রীষ্মকালীন সময় পোলিওর প্রাদুর্ভাবে প্রায় হাজার দশেক মানুষ পোলিও সংক্রমণের ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় একশো জন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে অথবা মৃত্যুবরণ করে।
রয়াল সোসাইটি অফ মেডিসিন সাময়িকীর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় দুই লাখের বেশি শিশুকে ত্রুটিপূর্ণ ওই টিকা দেয়া হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে টিকার প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যাবার খবর আসতে থাকে এবং পোলিওর গণ টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত রাখতে হয়। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে কাটার ল্যাবরেটরিসের তৈরি একটি ব্যাচের টিকায় ভাইরাস জীবিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। তাদের টিকা নিয়ে ৪০ হাজার শিশুর পোলিও সংক্রমণ হয়, ২০০ শিশু কমবেশি পঙ্গু হয়ে যায় এবং মারা যায় ১০ জন।
কাটার দুর্ঘটানার কয়েক সপ্তাহ আগেই আমেরিকান জীবাণু বিজ্ঞানী ও গবেষক জোনাস স্যল্ক ঘোষণা করেন বিশাল সংখ্যক সাধারণ মানুষের ওপর তার উদ্ভাবিত পোলিওর টিকার পরীক্ষা সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই টিকা উদ্ভাবনের খবরে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বিশ্বের মানুষ। মারাত্মক এই ভাইরাসের সংক্রমণে পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছিল মানুষ, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছিল শিশুরা। বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৫২ সালে আমেরিকায় পোলিও মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল।
ওষুধ কোম্পানিগুলোতে তড়িঘড়ি লেগে গিয়েছিল ভ্যাকসিন তৈরির কাজে। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট ওই ওষুধ কোম্পানি কাটার ল্যাবেরটরিস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরপর বেশ কয়েকটি ভুল করে বসল। জোনাস স্যল্কের উদ্ভাবিত সেই টিকা তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল ছিল বলে বিবিসিকে ব্যাখ্যা করেছেন কার্টার দুর্ঘটনার গবেষক অধ্যাপক পল অফিট, যিনি একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং টিকার ব্যাপারে বড় প্রবক্তা; তিনি এই দুর্ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
বিজ্ঞানী স্যল্ক পোলিওর জীবাণু নিয়ে সেটাকে প্রথমে জীবন্ত কোষের মধ্যে বড় করেন; মূলত বানরের কিডনির কোষের মধ্যে। এরপর সেই জীবাণু পূর্ণতা পাবার পর কোষ ও কোষের অন্যান্য বর্জ্য থেকে তিনি সেটিকে আলাদা করে ফেলেন, যাতে শুধু ভাইরাস ছাড়া সেখানে আর কিছু না থাকে। এরপর ফর্মাল্ডিহাইড নামে এক রাসায়নিক ব্যবহার করে জীবাণুকে তিনি নিষ্ক্রিয় করে দেন। তিনি দেখেন ওই নিষ্ক্রিয় ভাইরাস শিশুদের শরীরে ইনজেক্ট করলে তাদের শরীরে ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে।
টিকার ট্রায়ালের সময় শিশুদের মধ্যে রোগের কোন সংক্রমণ ঘটেনি, কারণ বিজ্ঞানী রাসায়নিক ব্যবহার করে ভাইরাসকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু যখন ব্যাপক পরিসরে টিকা তৈরির কাজ শুরু হয়, তখন জোনাস স্যল্ক টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কাছে যে নির্দেশাবলী পাঠান, তাতে যথেষ্ট তথ্য ছিল না বলে বলে মনে করেন পল অফিট। কাটার কোম্পানি ভ্যাকসিনের মধ্যেকার ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য যে ধরনের ফিল্টার ব্যবহার করেছিল, পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে সেই ফিল্টার ভাইরাসকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করতে পারেনি।
কাটার কোম্পানির ক্ষেত্রে ভাইরাসকে যে কোষের মধ্যে জন্ম দিয়ে বড় করা হয়েছে সেই কোষের বর্জ্য সেখানে থেকে গিয়েছিল, যার মধ্যে থেকে গিয়েছিল জীবন্ত ভাইরাসের অংশবিশেষ। জীবাণুকে পুরো কোষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে ওই জীবাণু সক্রিয় থেকে যায় আর সেটাই ঘটেছিল কাটারের তৈরি টিকার ক্ষেত্রে।
যদিও কাটার কোম্পানির পোলিও ভ্যাকসিনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাচটি ডাক্তাররা খুব দ্রুত চিহ্ণিত করতে সক্ষম হন। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ টিকাগুলো বাজার থেকে জব্দ করা হয়। তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ওই শিশুদের জীবনকে সারাজীবন হুইলচেয়ারে বন্দি করার জন্য ওই একটা ভুলই যথেষ্ট ছিল।
এমনকি কাটার কোম্পানিকে অবহেলার অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল; কারণ জুরিরা শুনেছিল জোনাস স্যল্কের উদ্ভাবিত টিকা পদ্ধতি অনুসরণ করে টিকা তৈরি করতে অন্য কোম্পানিগুলোকে কীভাবে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে অনিরাপদ টিকা বিক্রির জন্য জুরি কাটার ল্যাবকে দায়ী করে মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশ দিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ