পৃথিবীর বুকে এক সময় বিচরণ করতো যে অতিকায় ডাইনোসররা, আজ শুধু পাওয়া যায় তাদের হাড়গোড়। কারণ, এখন থেকে প্রায় ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগে এক ভয়ংকর ঘটনার পরিণতিতে তারা সবাই মারা গেছে। গবেষকরা মনে করেন পৃথিবীতে এক বিরাট আকারের গ্রহাণুর আঘাতে যে বিস্ফোরণ ও পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছিল সেটাই ডাইনোসরদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কারণ। সেই গ্রহাণুর আঘাতের পরোক্ষ অনেক চিহ্ন আজও রয়ে গেছে পৃথিবীর বুকে। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে ভূগর্ভে আবিষ্কৃত বিশাল অসমান পৃষ্ঠও সৃষ্টি হয়েছে ওই গ্রহাণুর আঘাতেই।
এ ধরনের অসমান পৃষ্ঠকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় ‘রিপল মার্কস’। বয়ে যাওয়া বাতাস বা পানিপ্রবাহের কারণে ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ ঢেউয়ের আকার ধারণ করলে সেটাই ‘রিপল মার্কস’। পৃথিবীর বুকে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সর্ববৃহৎ রিপল মার্কসটি রয়েছে লুইজিয়ানার ভূগর্ভে।
সায়েন্স নিউজের প্রতিবেদনে জানানো হয়, লুইজিয়ানার মধ্যাঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের দেড় হাজার মিটার গভীরে শৈলশিরার মতো বিন্যস্ত কাঠামোগুলোর উচ্চতা তিন তলা ভবনের সমান। দুটি আইফেল টাওয়ার পাশাপাশি যে পরিমাণ জায়গা নেবে, তার সমান এর পরিধি।
গবেষকরা মনে করছেন, গ্রহাণুটির আঘাতে সৃষ্ট সুনামিতে হয়েছে এ রিপল মার্কস।
লুইজিয়ানা ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ববিদ গ্যারি কিন্সল্যান্ড বলেন, ‘ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগে যা ঘটেছিল, তার প্রমাণ প্রকৃতিই সংরক্ষণ করেছে। বিষয়টি চমৎকার। লুইজিয়ানার পাঁচ হাজার ফুট গভীরে পলির জীবাশ্মে চাপা পড়ে আছে সেটি।’
গ্রহাণুটি আঘাত হেনেছিল বর্তমান মেক্সিকোর ইউকাতান উপদ্বীপে। এর প্রভাবে লুইজিয়ানায় সৃষ্ট রিপল মার্কসের গড় উচ্চতা ১৬ মিটার। একেকটির মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৬০০ মিটার।
গবেষকরা বলছেন, এত জোরে এটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল যে তাতে ২০০ কিলোমিটার চওড়া এবং কয়েক কিলোমিটার গভীর একটি গর্ত বা জ্বালামুখ তৈরি হয়েছিল। গর্তটির কিনারগুলো তার পর ভেতর দিকে ধসে পড়ে। এর ফলে সাগরে সৃষ্টি হয়েছিল এক ভয়াবহ সুনামি। তৈরি হয়েছিল দানবাকৃতির ঢেউ।
এই গর্তটির বড় অংশই এখন আছে সমুদ্রের তলায়— তার ওপর জমেছে ৬০০ মিটার পুরু পলির আস্তরণ। মাটির ওপর যে অংশ আছে তা চুনাপাথর দিয়ে ঢাকা।
বিজ্ঞানীরা ওই এলাকাটির উপাদান পরীক্ষা করে কোন সালফার বা গন্ধকের উপস্থিতি পান নি। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশের ওই জায়গাটির এক তৃতীয়াংশই ছিল জিপসামের তৈরি— যার অন্যতম উপাদান সালফার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই সালফার হয়তো ওই গ্রহাণুর আঘাতজনিত বিস্ফোরণে সাগরের পানির সাথে মিশে গিয়েছিল এবং তা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তার ফলে নাটকীয়ভাবে আবহাওয়া অত্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যায় এবং কোন প্রাণী বা গাছপালার বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে ওঠে।
বিজ্ঞানীদের অন্যতম টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শন গুলিক বলছেন, একশ গিগাটন (এক গিগাটন মানে হলো ১০০ কোটি টন) সালফার বায়ুমন্ডলে মিশে যাবার ফলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে অন্তত ২৫ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়।
তার মানে পৃথিবীর বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রা তখন নেমে গিয়েছিল শূন্য ডিগ্রির নিচে। এত ঠান্ডা আবহাওয়ায় স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বেঁচে থাকতে পেরেছিল, কিন্তু ডাইনোসররা বাঁচতে পারেনি।
কিন্সল্যান্ড জানান, রিপল মার্কগুলোর আকার, আকৃতি, দিক ও অবস্থানের ভিত্তিতে এটি ঐতিহাসিক গ্রহাণুর আঘাতের পরোক্ষ ফল বলে মনে করা হচ্ছে।
গ্রহাণুটির আঘাতে সুনামির কারণে মেক্সিকো উপসাগর থেকে বিপুল পরিমাণ পলি সরে লুইজিয়ানার দিকে এসেছিল। সে সময় অবশ্য এসব পলি পানির নিচেই ছিল, বর্তমানে যা জীবাশ্ম।
সুনামির ব্যাপকতা সত্ত্বেও এর প্রভাবে সৃষ্ট রিপল মার্কস এর আগে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৯
আপনার মতামত জানানঃ