রংপুরে স্কুলছাত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাহেনুল ইসলামসহ ৫জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পিবিআই। মামলা দায়েরের চারমাস পর আজ মঙ্গলবার (৯ মার্চ) দুপুরে পৃথকভাবে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এবং মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পিবিআইয়ের রংপুর পুলিশ সুপার এ বি এম জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, রিমান্ডে থাকাকালে এএসআই রাহেনুল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করছেন। এছাড়া ভুক্তভোগী নিজেও আদালতে তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তাদের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বস্তুগত তথ্য প্রমাণ এবং ডিএনএ পরীক্ষা শেষে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। জড়িতদের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
ওই ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, রংপুর নগরের হারাগাছ এলাকার নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন ডিবির এএসআই রায়হানুল ইসলাম। পরিচয়ের সময় রায়হানুল ওই ছাত্রীকে তার ডাকনাম রাজু বলে জানান। সম্পর্কের সূত্র ধরে রোববার সকালে ওই কিশোরীকে কেদারের পুল এলাকার শহিদুল্লাহ মিয়ার বাড়ির এক ভাড়াটের ঘরে ডেকে নেন রায়হানুল। সেখানে রায়হানুল ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর আরও কয়েকজন পরিচিত যুবক তাকে ধর্ষণ করেন।
নির্যাতিতার মা জানিয়েছেন, দুই সন্তানের জনক হলেও নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় এবং বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দিয়ে রাহেনুল আমার মেয়েকে নিজে এবং অন্যদের দিয়ে সর্বনাশ করেছে। এই অবস্থায় এই মেয়েটির ভবিষ্যৎ কি হবে। সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এবং জড়িত রাজুসহ অন্যদের ফাঁসি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয়, আমার মেয়েকে রাহেনুলসহ মেঘলা এবং সম্পা বগুড়ায় বিক্রি করার জন্য চেষ্টা করেছিল। সে হিসেবে কথা বার্তাও হয়েছিল বলে আমার মেয়ে আমাকে জানিয়েছেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, রংপুর মহানগর পুলিশের হারাগাছ থানাধীন ময়নাকুঠি কচুটারি এলাকার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন মহানগর ডিবি পুলিশের এএসআই রাহেনুল ইসলাম। পরিচয়ের সময় রাহেনুল তার ছদ্মনাম রাজু বলে জানান ওই ছাত্রীকে। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে ওই ছাত্রীকে গত ২৩ অক্টোবর সিগারেট কোম্পানির ক্যাদারের পুল এলাকায় সুমাইয়া আক্তার মেঘলা ওরফে আলেয়ার ভাড়া কার বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন।
পরে ২৪ অক্টোবর রাতে ভাড়াটিয়া মেঘলা ও তার সহযোগী সুরভি আক্তারের সহায়তায় বাবুল ও কালাম তাকে ধর্ষণ করেন।
এই ঘটনায় ওই ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে রাহেনুল ও মেঘলার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করে হারাগাছ থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।
পরে মামলাটি পিবিআই এ হস্তান্তর করা হয়। অভিযান চালিয়ে ওই দুই নারী এবং বাবুল ও কালামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং পুলিশ লাইনে সংযুক্ত এএসআই রাহেনুলকেও গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। সেইসঙ্গে রাহেনুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
তদন্ত শেষে মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সদস্য রাহেনুল এবং দুই নারী মেঘলা ও সুরভীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং মানবপাচার ও বাবুল এবং কালামের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তহীন অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধের কারণে সরকারি এ সংস্থাটি এখন নানা প্রশ্নের মুখে। সমাজের বিকৃত মানসিকতার একশ্রেণির মানুষের যৌন লালসার শিকারে পরিণত হয়ে চলেছে নারী ও শিশুরা। প্রশ্ন দাঁড়ায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন নিজেই ধর্ষক হয়ে যায়, তখন এই সমাজের নিরাপত্তার জন্য নারীরা কোথায় যাবে?
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ‘নারী নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধে পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ। পুলিশদের দ্বারাই এখন নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোথাও পুলিশ ধর্ষক, আবার কোথাও নিপীড়কের সহযোগী।’
তারা বলেন, হারাগাছে গণধর্ষণের শিকার স্কুল শিক্ষার্থীর পরিবারকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। এতে করে মামলার আসামিরা প্রকৃত শাস্তি পাবে না। বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এজন্য হুমকি প্রদানকারী প্রশাসনের সদস্যদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ধর্ষক এএসআই রায়হানুল ও তার সহযোগীদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ধর্ষণ নির্যাতনের মতো অপরাধ দমন হবে না।
আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে কোনো ধরনের ছাড় যেন না পায়। আমরা এই ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে আমাদের। শুধু শাস্তি দিয়েই সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। এটি চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না এ ব্যাপারে সমাজ সোচ্চার হবে।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ