মীর মোনাজ হক : ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০২ সালের এ দিনে বিখ্যাত ফরাসী লেখক ও সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো জন্ম গ্রহণ করেন। ‘টয়লার্স অব দ্যা সী’ বা সাগরের শ্রমিক, ‘দ্যা ম্যান হু লাফ’ বা হাসতো যে লোকটি শীর্ষক উপন্যাসগুলো ভিক্টর হুগোর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস ও নাটক রচনা করেন এবং সাহিত্যিক হিসাবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের যে তিনজন লেখকের তুলনা চলে ভিক্টর হুগো তাদের মধ্যে অন্যতম। বাঁকি দুজন হলেন, জার্মান লেখক গোথে ও রুশ লেখক লিও তলস্তয়।
তিনি একজন রাজনৈতিক প্রচারক হিসেবেও কাজ করেন। চেম্বার অফ কমার্স, সংসদ সদস্য বা সিনেটরের সদস্য হিসাবে তিনি বেশ কয়েকবার রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
টয়লার্স অফ দ্য সী (ফরাসি: Les Travailleurs de la Mer) ভিক্টর হুগোর লিখিত উপন্যাস। এই বইটি তিনি গেরনসি দ্বীপকে উৎসর্গ করেছেন যেখানে তিনি তার জীবনের ১৯ বছর কাটিয়েছেন।
তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস Les Misérables
“ল্যো মিজারেবল” বইটির পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে। লেখক উনিশ শতকের ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচের তলার সে সব মানুষের জীবনের এক সকরুণ জীবন চিত্র এঁকেছেন। যারা দুঃখ দৈন্যের অভিশাপে বিকৃত।
“সকল সভ্যতা শুরু হয় ঈশ্বরতন্ত্র দিয়ে আর শেষ হয় গণতন্ত্রে এসে।”
~ভিক্টর হুগো
উপন্যাসের নায়ক জা ভালজা। এমন বিবর্তনধর্মী চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে বিরল।সে তার জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন চারটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসে যারা তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেয়।সেই চারটি চরিত্র হল বিশপ মিরিয়েল, ইন্সপেক্টর জেভারত, ফাতিনের মেয়ে কসেত্তে এবং কসেত্তের প্রেমিক যুবক মেরিয়াস। যে সমাজ এ চোর ও অপরাধীর জন্যে নির্মম শাস্তির বিধান আছে ।কিন্তু গরিব দের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা নেই , উনিশ বছরের কারা দন্ড শেষে জেল থেকে বেড়িয়ে সে নিষ্ঠুর সমাজের প্রতি চরম ঘৃণা ও বিদ্রোহাত্মক প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে ভালজার সমগ্র আত্মা তখন বিশপ মিরিয়েল এর অপরিসীম দয়া সমস্ত ঘৃণা নিঃশেষ করে তার মন থেকে। এক মহা জীবনের পথ দেখায় হতাশা আর অন্ধকার থেকে। এরপর তার জীবনে আসে কর্তব্য পরায়ণ ও নীতিবাদী ইন্সপেক্টর জেভারত। ম্নত্রিউল সুর মের অঞ্চলে বিশাল সম্পদ ও মান সম্মান এর অধিকারী হয়। তখন একদিন জেভারত এসে তাকে বলে শ্যাম্পম্যাথিউ নামে এক লোক জা ভালজা নামে দন্ডিত হচ্ছে। ফলে আবার এক আত্মিক সঙ্কটে পড়ে সে। ভাবতে থাকে এই সম্মান এর জীবন বহন করবে নাকি সত্যটা মেনে নিয়ে শ্যাম্পম্যাথু কে মুক্ত করবে। অবশেসে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারা দণ্ড ভোগ করে সে। এরপর তার জীবনে আসে ফাতিনের মেয়ে কসেত্তে। জাকে আট বছর বয়সে থ্রেনাদিয়ের দের হোটেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে সে। এই কসেত্তের আভিরবা তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আত্মীয় স্বজনহীন জীবনে শিশু কসেত্তে নিয়ে আসে এক আশ্বাস। একাধারে পিতা ও ভ্রাতার সমন্বিত ভালোবাসা দিয়ে এক দুর্ভেদ্য জাল সে কসেত্তের জন্য রচনা করে। যা ছিন্ন করে কেউ তাকে তার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবেনা ভাবতে থাকে।তাই যখন সে জানতে পারে কসেত্তে মেরিয়াস নামে এক যুবক কে ভালোবাসে আবার সে আত্মিক সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু আত্মত্যাগের এক বিরল মহিমায় কসেত্তেকে স্বেচ্ছায় তুলে দেয় মেরিয়াসের হাতে এবং আত্মত্যাগ, আত্ম নিগ্রহ ও স্বেচ্ছা মৃত্যুর দিকে নিজেকে ঠেলে দেয় সে। এভাবেই সমস্ত কামনা বাসনা কে জয় করে মৃত্যুহীন এক মহাজীবনের আলোকমালা দেখতে পায় এবং মৃত্যুবরণ করে। এ যেন কোনো উপন্যাস নয়। জীবনের জয়, পরাজয়, উত্থান পতন সুকদুক্ষ আশা আখাঙ্খা সম্বলিত এক মহাকাব্য।
১৮৪৫ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ লা মিজারেবল লেখার সময়, ফরাসি রাজা লুইস ফিলিপে তাকে ফ্রান্সের উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আইনসভার সর্বোচ্চ দলের সঙ্গে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। তিনি সেখানে সবার জন্য বিনা খরচে লেখাপড়া, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির ব্যাপারে কাজ করা শুরু করেন।
ভিক্টোর হুগোর জয়গান যখনই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেই সময় বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। বাংলাভাষায় ফরাসি সাহিত্যে চর্চার ইতিবৃত্তে আরো বৃহত্তর পরিধিতে বাঙালির ফরাসি সংস্কৃতির পরিগ্রহণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকে বাদ দেওয়া যায় না। ফরাসি কবি রঁমা রল্যাঁ’র সাথে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনেও ভিক্টর হুগোর প্রভাব কাজ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘হিং টিং ছট’ (১৮৯২) কবিতায় ইয়োরোপীয় পণ্ডিতের পাশাপাশি মধ্যে কৌতুকপ্রিয়, ভদ্র, শ্লেষ ও যমক সৃস্টিতে চতুর ফরাসি পণ্ডিতের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে শিক্ষিত বাঙালির কল্পনায় ইয়োরোপীয় চরিত্রের উগ্রমূর্তি সাধারণকল্পরূপের পাশে তুলনামূলকভাবে ফরাসি চরিত্রের কল্পরূপ বা ভাবমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে। হুগো ছাড়াও ফরাসি সাহিত্যিক মোলিয়ে, প্যাস্কাল, এমিল জোলা ও গোতিয়ের লেখার পাঠকও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
শান্তিনিকেতনের এক নথি থেকে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ভিক্টোর হুগোর লেখা পড়ার জন্যাই ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন।
হুগোর মৃত্যুর ন’বছর পরে বঞ্চিমচন্দ্রের মৃত্যুর বছর (১৮৯৪) ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশে সাহিত্যে গৌরবের অভাবের জন্য আক্ষেপের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ফ্রান্সের সাহিত্য–মনস্কতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘সাহিত্যের পথে’ প্রন্থে সংকলিত ‘সাহিত্যরূপ’ (১৯২৮) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের হুগো সম্পর্কিত মন্তব্য তাঁর শ্রদ্ধার পরিচায়ক। দান্তে ও গ্যেটের সঙ্গে এখানে হুগোর নাম উচ্চারিত হয়েছে।
১৮৮৫ সালের ২২ মে এক বিকেলে শ্রমিকের মলিন পোশাকে প্যারিসের ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছেন হুগো। একটি মেয়ে তাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বলল— কী আশ্চর্য! তোমাকে তো দেখতে একদম ভিক্টর হুগোর মতো লাগছে। আমি তো ভেবেছিলাম কোন কালে মরে গেছেন তিনি। মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলেন হুগো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। সেদিন রাতেই মৃত্যু হলো ভিক্টর হুগোর।
তথ্যসূত্রঃ Klassikar-der-weltliteratur, Victor Hugo Leben und Werk
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক। বার্লিন, জার্মানী।
আপনার মতামত জানানঃ