ভিন্ন কোনও গ্রহে প্রাণ আছে কি না, তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে মানুষ এখন এরকম প্রাণের সন্ধানই করছে। তবে যদিওবা নিকট ভবিষ্যতে কোনও প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটা অতি ক্ষুদ্র অনুজীবতুল্য প্রাণ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
কিন্তু ড্রেকের সমীকরণ অনুযায়ী, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বিবেচনা করলে, মহাজাগতিক প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান পেয়েছেন। এবং পানির অস্তিত্বের কারণে এসব এক্সোপ্ল্যানেটের অনেকগুলোতেই প্রাণের সম্ভাব্য অস্তিত্ব থাকতে পারে।
চলুন প্রথমে জানা যাক, ড্রেকের সমীকরণ সম্পর্কে। আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগের কথা। ঠিক এমন একটা প্রশ্ন নিয়েই ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধানে নেমেছিলেন জ্যোতির্বিদ ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক (Frank Drake)। হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পর তখন সবেমাত্র তিনি নিযুক্ত হয়েছেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরিতে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার একটা বাড়তি সুযোগ পেয়ে যান ড্রেক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অবজারভেটরিতেই ছিল তৎকালীন সময়ের সবথেকে শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ। যা ১২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোনো নক্ষত্রে বার্তা প্রেরণে সক্ষম।
না, সুযোগ হাতছাড়া করেননি ড্রেক। বরং, রুটিন কাজের ফাঁকেই শুরু হয় ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধান। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রোজেক্ট ওজমা। প্রাথমিকভাবে ড্রেকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি বিজ্ঞানীমহল। বরং, উপহাস্যের বিষয় হয়ে ওঠে প্রোজেক্ট ওজমা। সাফল্যের অভাবে কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধও হয়ে যায় এই প্রকল্প। তবে হাল ছাড়েননি ড্রেক।
১৯৬১ সালে ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্টিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘সেটি’-র সম্মেলনে গিয়ে নতুন চিন্তা দানা বাঁধে তাঁর মনে। আর তা হল গাণিতিক উপায়ে ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নির্ণয়। মাস খানেকের মধ্যে আস্ত সমীকরণও বানিয়ে ফেলেন ড্রেক। ‘ড্রেকের সমীকরণ’ হিসাবেই যা পরিচিত আজ।
এবার ফেরা যাক আজকের আলোচনায়। হঠাৎ করে কোনও একদিন এলিয়েনেরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বসলে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? আমরা তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব?
যেসব প্রাণী মানুষ নয়, সেগুলোর অধিকার নিয়েও স্পষ্ট, কার্যকর ও সর্বজনীন কোনও ধারণা তৈরি হয়নি এখন পর্যন্ত। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের অধিকার নিয়েও আমরা ছিনিমিনি করি। সে কারণেই সম্ভবত সায়েন্স ফিকশনের লেখকেরা এলিয়েনদের প্রতি আমাদের সম্ভাব্য আচরণ নিয়ে বেশি আশা করতে পারেননি।
মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অভ হিউম্যান রাইটস ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এ অধিকারগুলো সব মানুষের জন্য সমানভাবে কার্যকর করা কখনোই সম্ভব হয় না।
পৃথিবীতে অন্য প্রাণীর ওপর মানুষের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই নৃশংস ও নিন্দনীয়। সেক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, ও দুর্বল কোনও মহাজাগতিক প্রাণী যদি পৃথিবীতে এসে হাজির হয়, তাহলে তার ভাগ্যে কী ঘটবে সেটা কিছুটা আঁচ করা যায়।
সম্পূর্ণ অপরিচিত এলিয়েন প্রজাতির অধিকার মানুষের জন্য মানুষের তৈরি আইনি ও নীতিগত কাঠামোয় কীভাবে যোগ করা সম্ভব তা নিয়ে অনেক নীতিবিশারদই ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
মহাজাগতিক প্রাণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ মানুষ কীভাবে সামলাবে, এ নিয়ে বিশ্বের দেশগুলো আন্তর্জাতিকভাবে এখনো কোনও সমঝোতায় পৌঁছায়নি। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মহাকাশবিষয়ক সব আইনই মানুষকে নিয়ে।
এসব আইনে মহাকাশে অস্ত্রের ব্যবহারের বিধিনিষেধ থেকে শুরু করে এক দেশের মহাকাশ অভিযানের কারণে অন্য দেশের ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা — সবই রয়েছে। মহাকাশে এলিয়েন সংশ্লিষ্ট কোনও আইনি কাঠামো এখনো কেউ তৈরি করতে পারেনি।
তবে ইন্টারন্যাশনাল আ্যাকাডেমি অভ অ্যাস্ট্রোনটিকস-এর দ্য সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স দলটি ২০১০ সালে এ বিষয়ে একটি পরিকাঠামো তৈরি করেছে। এলিয়েনের আগমন নিয়ে আগের দশকগুলোতে বিভিন্ন বিতর্কের ওপর ভিত্তি করে এ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়।
যদি পৃথিবীতে কখনো এলিয়েনের পাঠানো কোনও সিগন্যালের কথা জানা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে তা সমন্বয়ের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি ফোরাম তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই ফ্রেমওয়ার্কটিতে।
তবে একান্ত দরকার না হলে সারাবিশ্বে বিস্তৃত পরিসরে গ্রহণযোগ্য কোনও ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার বিষয়ে কেউ এগিয়ে আসবে না বলে মনে করেন লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিক্স-এর মহাকাশ আইন বিশেষজ্ঞ জিল স্টুয়ার্ট।
এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যদি কখনো এলিয়েনরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাহলে বর্তমানে মানুষের অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে তৈরি করা মহাকাশবিষয়ক আইনি কাঠামোগুলোকেই বিস্তৃত ও খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি বড় বিবেচনার বিষয় হচ্ছে এলিয়েনের পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য — তারা কি খারাপ উদ্দেশ্যে, পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য আসছে, নাকি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে। আর এ কারণেই আমাদের আদৌ এলিয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা উচিত কি না সে নিয়েও রয়েছে প্রচুর বিতর্ক।
সে যা-ই হোক, ধার যাক, কোনও দেশের সীমানার ভেতরে একটি এলিয়েন মহাকাশযান ক্র্যাশ-ল্যান্ড করল। এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও প্রটোকল এখনো কোনও দেশের কাছে নেই। তবে এক্ষেত্রে ওই দেশটিকেই বিষয়টি সামলানোর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হবে বলে মনে করেন স্টুয়ার্ট।
তবে এলিয়েনের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি হতে পারে, মানবাধিকারের প্রয়োগ করা। অর্থাৎ মানুষের জন্য যেসব অধিকার রয়েছে, পৃথিবীতে অভ্যাগত এলিয়েনদের জন্যও সে-সব অধিকার কার্যকর করা।
পৃথিবী পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারা এলিয়েনরা অতিবুদ্ধিমান ও সংবেদী ক্ষমতাসম্পন্ন হবে বলে ধারণা করাই যৌক্তিক। তাই তাদের সঙ্গে মানুষের মতোই আচরণ করা উচিত। এ মানবাধিকারই পরে ‘সংবেদী অধিকারে’ বিবর্তিত হতে পারে।
এলিয়েনরা যদি মানুষের মতো বেদনা অনুভব করতে পারে, তাহলে তাদের বিষয়ে মানুষের কিছু নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত বলে মনে করেন লেখক এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অভ প্লাইমাউথ-এর ভিজিটিং প্রফেসর সুসান ব্ল্যাকমোর।
তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ একটি আইনি কাঠামো তৈরি করতে পারে বলেও মত প্রকাশ করেন ব্ল্যাকমোর। মহাজাগতিক প্রাণ নিয়ে লেখালেখি করা আরেক নীতিবিদ পিটার সিংগারও মনে করেন, পৃথিবীর অতিথি কোনও এলিয়েনের যদি ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা থাকার কথা জানা যায়, তাহলে এলিয়েনের অধিকার প্রসঙ্গে সবচেয়ে মৌলিক বিবেচনার দিক সেটিই হবে।
আমাদের পৃথিবীতে কোনও এলিয়েন পৌঁছাতে পারলে তারা মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমানই হবে। কিন্তু এ এলিয়েনরা যদি আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে হানা দেয়? তারা কি তখন আমাদের অধিকার নিয়ে চিন্তা করবে?
মহাজাগতিক প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধান চালানো মার্কিন গবেষণা সংস্থা এসইটিআই ইনস্টিটিউট-এর জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ সেথ শস্টাক এ ধরনের পরিস্থিততে মানুষকে নিয়ানডারথাল আর এলিয়েনকে মার্কিন বিমান বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
শস্টাক বলেন, ব্যাপারটা এমন হবে, যেন নিয়ানডারথালেরা মার্কিন বিমান বাহিনীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছে: নিয়ানডারথালদের কাছে তখন যতই আইন-নীতি থাকুক না কেন, তা কোনও কাজে আসবে না।
আপনার মতামত জানানঃ