ইউরোপে যাওয়ার জন্য এদেশের অনেক বেকার যুবকেরই রয়েছে তীব্র আগ্রহ। কিন্তু ইউরোপ যাওয়ার মতো তাদের তেমন সামর্থও নেই। যারা ঘরবাড়ি বন্ধক কিংবা বিক্রি করে বা সুদে টাকা নিয়ে অর্থের ব্যবস্থা করেন, বিভিন্ন অবৈধ এজেন্সিরা তাদের ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে চোরাপথে ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফেলে আসে। তারপর পরিবারের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। অন্যথায় জঙ্গলেই ধুকে ধুকে মরতে হয়। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের একটি দল অবৈধ এজেন্সির চারজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। যারা চাকরি ভিসায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার(০৭ জানু) সিআইডির সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ, জামাল হোসেন ও নাহিদুল ইসলাম পলাশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৮টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দূতাবাস, ব্যাংক, এজেন্সির ১৯টি সিলমোহর ও কম্বোডিয়ার ১০টি জাল ভিসা জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে (মাল্টা, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, মিশর মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া) পাঠানোর কথা বলে টাকা নেয়। পরে তারা অনুমোদনহীন এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া প্রথমে ভিজিট ভিসায় ভারতে পাঠাতো। ভারত নেওয়ার পর ভুয়া ভিসা দিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছুদের পরিবারের কাছ থেকে নানাভাবে টাকা হাতিয়ে নিতো। টাকা না দিলে বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করে টাকা আদায় শেষে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হতো। এই সংঘবদ্ধ চক্রে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের দালাল চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
শেখ ওমর ফারুক বলেন, আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, তারা ছয়-সাত বছর ধরে এই কাজ করে আসছে। তবে আরো তথ্য পেয়েছি তারা প্রায় একশ লোককে এভাবে পাচার করেছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত সেসব ভিকটিমদের সন্ধান পাইনি।
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, তারা প্রথমে লোক সংগ্রহ করার পর ঢাকা থেকে বিআরটিসি বাসে করে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছে দিতো। এরপর সেখানে বিদেশে পাঠানোর জন্য সংগ্রহ করা ব্যক্তিদের অন্য দালালের হাতে তুলে দিতে। সেখানকার দালাল তাদের কৌশলে কলকাতা পাঠাতো। সেখানেও দালালের মাধ্যমে তারা ইউরোপের জন্য সংগৃহীত ব্যক্তিদের হায়দরাবাদ নিয়ে যেতো। সেখানে নেওয়ার পর সেখানকার দালালরা ওইসব ব্যক্তিদের মারধর করে আরো টাকা আদায় করতো। আর সেখান থেকে প্রত্যাশিত টাকা আদায়ের পর মানবপাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ট্রলার বা নৌকায় করে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো বিভিন্ন দেশের গহীন জঙ্গলে ফেলে রেখে আসতো।
অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সেসব জঙ্গল থেকে কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে আসলেও অনেকেই তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতো। এভাবে তাদের কাছ থেকে আরও টাকা আদায় করতো চক্রটি। কিন্তু সম্প্রতি প্রায় ২৭ জনকে নিয়ে যাওয়ার পর কৌশলে শ্রীলঙ্কার জঙ্গল থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে চারজন। তারা দেশে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে। সে ঘটনার সূত্র ধরে আমরা চারজনকে গ্রেফতার করেছি। এদের সঙ্গে আরো দুইজন জড়িত রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চক্রটির বিভিন্ন দেশে সদস্যরা কাজ করছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। কারণ যারা পালিয়ে এসেছে তারা বলেছে যেসব স্থানে গেছে সেসব স্থানে স্থানীয় ব্যক্তিদের একাজে জড়িত থাকতে দেখেছে। তাই আমরা আরো বিশদ তদন্ত শেষে সেসব দেশের সঙ্গে (ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) যোগাযোগ করে তাদেরও আইনের আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করবো।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুড়াবাড়ি গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, ‘মাল্টা পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয় চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়ই ৮ লাখ টাকা দিই। বলেছিল, চাকরিতে জয়েন করার পর বাকি টাকা নেবে। কিন্তু ভারতের হায়দারাবাদে নিয়ে নির্যাতন করে বাকি চার লাখ টাকা আদায় করে আমাকেসহ আরও প্রায় ২৬ জনকে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফেলে দেয়। আমিসহ চারজন সেখানকার স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাড়িতে ফোন করে ৩৩ হাজার টাকা এনে দেশে ফিরি।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো আগাছার মতো ছড়িয়ে আছে এসব অবৈধ এজেন্সি। এসব এজেন্সির অধিকাংশেরই পরিচালক কিংবা মালিক থাকেন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের প্রভাবের ওপর নির্ভর করেই স্থানীয় দরিদ্র লোকজন ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং দিনশেষে বাড়িঘর বিক্রি করে গেলেও অবশিষ্ট সহায় সম্বল বিক্রি করেও বাড়ি ফিরতে পারেন না। এটা দেশের গ্রামাঞ্চলে খুবই সাধারণ কথায় পরিণত হয়ে গেছে যে, ইউরোপ যেহেতু অনুমোদন নিয়ে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ঘুরতি পথ অর্থাৎ প্রথমে ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কা গিয়ে সেখানকার চক্রের সাহায্যে স্থানীয় ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে ইউরোপের দিকে আগান। প্রায় প্রতিটা গ্রামেই রয়েছে এমন ঘটনার শিকার বেকার যুবক যারা সব হারিয়ে আগের কর্মস্থলে ফিরে গেছেন। এসব কাজে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রশাসনের লোকজনও জড়িত থাকেন বলে মত প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সরকারের প্রতি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, এখনো যে পরিমাণ ভিক্টিম ভারত শ্রীলঙ্কা কিংবা মালদ্বীপে ছড়িয়ে আছে তাদের সংখ্যা প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যার চেয়ে অতোটা ছোট হবে না। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ভিক্টিমদের দেশে ফিরিয়ে আনারও আহ্বান জানান তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৩
আপনার মতামত জানানঃ