আতাউর রহমান : একের পর এক মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হলেও উল্টো রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অভিযোগ করছে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের মাধ্যমে পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দাবি, এ আইনের অন্তত দুটি ধারার অপব্যবহার করছে পুলিশ। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ২০(১) ও (২) ধারা দুটির আংশিক সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ওই আইনের ২০ (১) ধারায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে মানব পাচার রোধে প্রতিরোধমূলক তল্লাশি করা, যে কোনো আঙিনায় প্রবেশ করা এবং মানব পাচারের মতো কোনো অপরাধ সংঘটনে ব্যবহূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমন সরঞ্জামাদি বা তথ্য-প্রমাণ বা দলিল আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ২০-এর (২) ধারায় বিনা পরোয়ানায় এই তল্লাশি এবং জব্দ করার ক্ষমতা রয়েছে পুলিশের। উপপরিদর্শকের নিচে নন, এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দাবি করে আসছে, আইনের এ দুটি ধারার অপব্যবহার করে পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। যখন-তখন রিক্রুটিং এজেন্সি অফিসে তল্লাশির নামে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পাসপোর্ট জব্দ করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে জনশক্তি রপ্তানিতে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে ভাটা পড়তে পারে। ওই আইনের দুটি ধারা সংশোধনের জন্য বিভিন্ন সময়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেন-দরবারও করা হয়।
সূত্র জানায়, এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ২০ (১) ও (২) ধারা আংশিক সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মানব পাচার প্রতিরোধ, দমন ও পাচারের শিকার ব্যক্তিবর্গের সুরক্ষার জন্য ২০১২ সালে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’ প্রণীত হয়। তা ছাড়া জনশক্তি রপ্তানি খাতের সুষ্ঠু ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘বহির্গমন অধ্যাদেশ-১৯৮২’কে অধিকতর যুগোপযোগী করে প্রণীত ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন প্রণয়ন করা হয়। এ দুটি আইনের মধ্যে একটি ধারায় বৈপরীত্য থাকায় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে সমস্যা হচ্ছে মর্মে প্রতীয়মান।
চিঠিতে আরও বলা হয়, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ২০ (১) ও (২) ধারার আওতায় বিনা পরোয়ানায় পুলিশ বাহিনীকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়ায় এ আইনের অপব্যবহার হচ্ছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মানব পাচার কিংবা এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজে কোনোভাবেই জড়িত নয়। এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো পুলিশের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছে মর্মে বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে পুলিশি হয়রানি এখনও বন্ধ হয়নি। এ অবস্থায় মানব পাচার প্রতিরোধের নামে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে পুলিশের অযথা হয়রানি বন্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ২০ (১) ও (২) ধারা আংশিক সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আইনমন্ত্রীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি বেনজীর আহমেদ সমকালকে বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের অধীনে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো জনশক্তি রপ্তানি করে থাকে। এই আইন ভঙ্গ করলে সেখানে শাস্তির বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পুলিশ মানব পাচার আইনের ২০ (১) ও (২) ধারার ক্ষমতাবলে অযথাই রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে আসছে। তারা পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজ জব্দ করছে। এই হয়রানি বন্ধের জন্য তারা আইনটির ওই দুটি ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন।
অবশ্য পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা সমকালকে বলেন, বিভিন্ন সময়েই মানব পাচারের অভিযোগ এসেছে। জনস্বার্থেই পুলিশ এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার পুলিশি হয়রানির সুযোগ নেই। তারপরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সমকালকে বলেন, মানব পাচার আইনটি ভালো হলেও এর বাস্তবায়নের গতি একেবারেই কম। আইন তৈরি বা এর সংশোধন বড় বিষয় নয়। কোনো পাচারকারী পার পাবে না, কোনো বৈধ জনশক্তি রপ্তানিকারক হয়রানির শিকার হবেন না- সংশ্নিষ্টরা এটা মানলে সব সমস্যার সমাধান হবে। আইনের মধ্যে থেকে পুলিশ কাজ করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আইনের মধ্যে থেকে পুলিশ কাজ করে। মানব পাচারের অভিযোগ পেয়ে বা মামলা হলেই অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিতে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। আইন অনুযায়ী নানা আলামত সংগ্রহ করে। কাউকে হয়রানির সুযোগ নেই। বিদ্যমান আইনের আলোকে পুলিশ যেমন কাজ করে আসছে, ভবিষ্যতে কোনো নতুন আইন হলে বা আইন সংশোধন হলে পুলিশ সে আলোকেই অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।
খবর : সমকাল, পৃষ্ঠা ২০ / নভেম্বর ৩ ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ