ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনের বাড়ি ‘প্রতীচী’র সীমানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ঢুকে গেছে বলে অভিযোগ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছেন অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলাতেই জমি নিয়ে এই বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন তারা।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দাবি, গত শতকের চল্লিশের দশকে অমর্ত্য সেনের বাবা আশুতোষ সেনকে ১২৫ ডেসিমেল জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছিলো। এই জমিতেই অমর্ত্যবাবুদের পারিবারিক বাড়ি ‘প্রতীচী’ তৈরি করা হয়েছে। ২০০৬ সালে অমর্ত্য সেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে জমির ইজারা মালিকানা তার নামে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু জমি পরিমাপ করে দেখা যায় যে, পাশাপাশি দুটি লিজ দেয়া জমির মধ্যবর্তী বিশ্বভারতীর নিজস্ব ১৩ ডেসিমেল জমি ঢুকে গেছে ‘প্রতীচী’র সীমানায়। সেই হিসেবে ‘প্রতীচী’র জমির পরিমান এখন ১৩৮ ডেসিমেল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আরও অভিযোগ, রজতকান্ত রায় যখন উপাচার্য ছিলেন, তখন অমর্ত্যবাবুকে বিষয়টি একাধিকবার মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তিনি কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেননি।
তবে অমর্ত্য সেন বলছেন, “বিশ্বভারতীর যে জমিতে আমাদের বাড়ি, সেটি পুরোপুরি দীর্ঘমেয়াদি লিজ নেওয়া আছে, এবং সেই লিজের মেয়াদ ফুরোতে এখনও বহু দেরি আছে। আমার বাবা নিজে আরও কিছু জমি কিনেছিলেন, সুরুল মৌজার সরকারি খতিয়ানে তার মালিকানার তথ্যও যথাবিধি নথিভুক্ত আছে।“
১৯৪০ সালে বাড়িটি তৈরি করা হয়। তার ৮০ বছর পর কীভাবে এমন অভিযোগ উঠল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, “শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঐতিহ্য ও উপাচার্যের আচরণের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারতাম। কারণ, তিনি বাংলার ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবেই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত হয়েছেন।“
বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অমর্ত্য সেনের পক্ষে এই ঘটনার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন। অভিযোগ করে বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বলেই অমর্ত্য সেনের মতো মনীষীকে আক্রমণ করা হচ্ছে। শুক্রবার সরাসরি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘বিশ্বভারতীতে কিছু নব্য বহিরাগত আপনার পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে আশ্চর্যজনক এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন। এতে আমি বেদনাহত এবং দেশের সংখ্যাগুরুদের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যে লড়াই আপনি শুরু করেছেন, আমি তাকে পূর্ণ সমর্থন জানাই। এই লড়াই-ই আপনাকে এসব অসত্য শক্তির শত্রুতে পরিণত করেছে।“ অসহিষ্ণুতা ও সর্বগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে তাকে ‘বোন ও বন্ধু’ হিসেবে গণ্য করার জন্যও অমর্ত্য সেনকে অনুরোধ করেছেন মমতা ব্যানার্জি। চিঠিতে বাংলার পক্ষ থেকে অমর্ত্য সেনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন মমতা।
রবিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির সামনে প্রতিবাদ সভা করেন বুদ্ধিজীবীরা। অমর্ত্য সেনের পাশে থাকার বার্তা নিয়ে এদিন প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী, সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী, কবীর সুমন, ব্রাত্য বসুসহ অনেক বুদ্ধিজীবীরা। রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য ব্রাত্য বসু বলেন, “যেহেতু অমর্ত্য সেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, তাই তাঁর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিহিংসার মনোভাব কাজ করছে। এসব কিছু বলার বা মন্তব্য করার আগে মনে রাখতে হবে তিনি একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।“
এই বিতর্ক প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অমর্ত্য সেন স্পষ্টভাবে জানান, ‘‘বিশ্বভারতী কোনও দিন আমাদের জমি নিয়ে কোনও অনিয়মের কথা জানায়নি।“ এই বিষয়কে আইনের মাধ্যমে মোকাবিলা করবেন বলে জানান অমর্ত্য সেন।
আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, “বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের মতাদর্শের বিরুদ্ধে অমর্ত্য সেন দীর্ঘদিন ধরেই সরব। অমর্ত্য সেনের অভিযোগ, ভারতে বহু শতক ধরে চর্চিত বহুত্ববাদী ভাবধারাকে ধ্বংস করতে চায় কেন্দ্রের শাসকশক্তি। এ জন্য অতীতে বহুবারই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। বলা হচ্ছে, ‘প্রতীচী’র জমি ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ তোলাটা সেই আক্রমণেরই নতুন দিক।“
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, “নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ক্ষমতায়িত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।“
অমর্ত্য সেনের জন্ম ও পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। তার দাদু (মায়ের বাবা) সংস্কৃত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন। বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক।
এসডব্লিউ/কেএফ/০৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ