প্রতিটি প্রাণীর মতো মানুষের শরীরেও নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ প্রাণীই তাই দিয়ে নিজেকে সুস্থ রাখতে সক্ষম। তবে প্রকৃতিতে কিছু অতি সক্রিয় প্রাণী রয়েছে, যারা জীবনের প্রয়োজনে এমনসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় যে, কেবল অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা দিয়ে তাদের রোগ নিরাময় হয়ে যায় না। এ ধরনের প্রাণীগুলো প্রকৃতির নানা উপাদান থেকে রোগপ্রতিরোধী উপকরণ সংগ্রহ ও সেবন করে থাকে। মানুষও এই গোত্রের মধ্যেই পড়ে।
তবে মানবজাতি সক্রিয়তার প্রশ্নে প্রকৃতিতে থাকা আর সব প্রাণীর চেয়ে অনেক এগিয়ে। ফলে প্রকৃতি থেকে সময়মতো উপকরণ সংগ্রহ করে চিকিৎসা করা অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাছাড়া মানুষের সমাজের নিজস্ব আর্থ-সামাজিক বিধিবিধানও রয়েছে। যে কারণে মানুষ ওষুধ উদ্ভাবন করেছে এবং কালের পরম্পরায় তা এখন অনেকাংশেই প্রাকৃতিক উপকরণের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক ল্যাবরেটরির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন অবস্থা এমন যে, ওষুধ ছাড়া মানুষ অচলপ্রায়। এক করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকের অভাবে সারা বিশ্ব অন্তত ছয় মাস কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ফলে টিকার জন্য হাহাকার শুরু হয় এবং তা কম সময়ে উদ্ভাবনও সম্ভব হয়। এই যখন অবস্থা, তখন ওষুধের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। তদন্তে তথ্য মিলছে, ওষুধ মানুষের অভ্যন্তরীণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জায়গা দখল করে এবং ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন আনে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওষুধ খাওয়ার ফলে রোগ সেরে গেলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে যায় মানব শরীরে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওষুধের এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মানুষের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে, যা সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝা মুশকিল। সম্প্রতি বিবিসি ওষুধের কারণে মানুষের বদলে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে নাম প্রকাশ না করে ‘রোগী ৫’ নামের এক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ওই ব্যক্তিকে কোলেস্টেরল কমানোর এক ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। রোগী-৫-এর চিকিৎসা শুরুর পর তার স্ত্রী নিজের স্বামীর পাল্টে যাওয়া খেয়াল করেন। আগে যে মানুষ ছিলেন স্বল্পভাষী ও সদালাপী, তিনিই প্রচণ্ড রাগ করতে শুরু করেন কথায় কথায় এবং ঘরের বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেন।
ওই রোগী নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এতটাই হারিয়ে ফেলেন যে, দুর্ঘটনার ভয়ে গাড়ি চালানোও বন্ধ করে দেন। স্বামীর এই পরিবর্তন দেখে হাসপাতালের শরণাপন্ন হন স্ত্রী। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক বিটরাইস গোলম্ব জানান, ওষুধের কারণে ওই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন ঘটেছে। তবে ডাক্তাররা ওই ব্যক্তিকে ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে বললেও তিনি তা বন্ধ করে দেন। আশ্চর্যজনকভাবে ওই ওষুধ খাওয়া বন্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যেই রোগী-৫ তার স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বে ফিরে আসেন।
অধিকাংশ রোগীই ওষুধ খাওয়ার ফলে তাদের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের বিষয়টি ধরতেই পারেন না। কিছু ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি যখন নিজের পরিবর্তন বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। প্যারাসিটামলের মতো ওষুধে থাকা অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যাজমার জন্য নেওয়া ওষুধের কারণে মানুষের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে তা দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। অনেক দেশে এই ওষুধ উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১১ সালে ফরাসি এক বাবা ওষুধ কোম্পানি গ্যাক্সোস্মিথক্লেইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। পারকিনসন রোগের জন্য তিনি যে ওষুধ খাচ্ছিলেন, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি নিজেকে একজন জুয়াড়ি হিসেবে আবিষ্কার করেন।
বিশ্বে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ওষুধগুলোর কারণে লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসছে। নানা কারণে বিশ্ব আজ এমন এক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যেখানে মানুষকে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার জন্য অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার ফলে বিশ্বের মানুষ কোন দিকে এগোচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কিত বিজ্ঞানীরা। তারা প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে পুনর্জাগরিত করার ওপর জোরারোপ করছেন।
এসডাব্লিউ/ডিআর/আরা/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ