মানুষের জিন রহস্যের (জিনোম) পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ করতে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ইভান ইয়লার জানিয়েছেন, গবেষণাটি মানুষে মানুষে কেন ডিএনএর ধরনে পার্থক্য হয় এবং এই বৈচিত্র্য ও তফাত কীভাবে জিনগত রোগ নিরাময়ে কাজ করবে, সেই চেষ্টায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
টেলোমেয়ার টু টেলোমেয়ার (টি২টি) কনসোর্টিয়াম নামের যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থার প্রায় ১০০ বিজ্ঞানীর করা এই কাজ বৃহস্পতিবার(৩১ মার্চ) প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্রটি।
২০০৩ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা মানুষের জিন রহস্যের ৯২ শতাংশ উন্মোচন করতে সফল হন। তবে বাকি ৮ শতাংশ ডিএনএর জটিল গঠন প্রকাশ করতে পারেননি।
এর দুই দশক পর, এই বিজ্ঞানীরা সেই ৮ শতাংশ জিনের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি হিউম্যান জিনোমের শতভাগ প্রকাশ করতে সফল হয়েছেন বলে দাবি করেন।
এই কনসোর্টিয়ামের বিজ্ঞানীদের করা পূর্ণাঙ্গ গবেষণায় ডিএনএর জিনে থাকা ৩০৫ কোটি ৫০ লাখ বেইজ পেয়ার শনাক্ত করা গেছে। এগুলো হচ্ছে ক্রোমোজম ও জিনের মূলভিত্তি।
এগুলোর মধ্যে অতিগুরুত্বপূর্ণ ১৯ হাজার ৯৬৯টি প্রোটিন সমৃদ্ধ জিন রয়েছে। এদের মধ্যে এবার নতুনভাবে দুই হাজারটির রূপ ও প্রকৃতি বের করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এদের অধিকাংশই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেবল সক্রিয় থাকে ১১৫টি।
সেই সঙ্গে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আরও ২০ লাখ নতুন জিনের শ্রেণিবিন্যাস করতে পেরেছেন। এদের মধ্যে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এখন পর্যন্ত ৬২২ জোড়া নিয়ে কাজ চলছে।
এই গবেষণাটিকে বিজ্ঞানের যাত্রায় অবিশ্বাস্য সফলতা উল্লেখ করে ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইরিক গ্রিন বলেন, ‘গবেষণাপত্রটিতে পরিপূর্ণভাবে উঠে এসেছে আমাদের ডিএনএ-এর সবদিক। এটিকে বলা যেতে পারে মানব ডিএনএ-র ব্লু-প্রিন্ট।’
‘গবেষণাপত্রটিতে পরিপূর্ণভাবে উঠে এসেছে আমাদের ডিএনএ-এর সবদিক। এটিকে বলা যেতে পারে মানব ডিএনএ-র ব্লু-প্রিন্ট।’
জিন গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘কোনো কিছু থেকে উদ্ভূত হওয়া’ বা শিকড়। একটি বিস্তৃত ডিএনএ অণুর নির্দিষ্ট খণ্ডাংশ, যা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে তাকে জিন বলে। সব জীবদেহই অসংখ্য কোষের সমষ্টি। সব কোষেই বংশগতিক পদার্থগুলো বহনের জন্য ডিএনএ থাকে। কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিউক্লিয়াস। এখানেই থাকে ক্রোমোজোম নামের রাসায়নিক তন্তু। ক্রোমোজোম দুই ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিড ও দুই ধরনের প্রোটিন দিয়ে গঠিত। ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ হচ্ছে ক্রোমোজোমের একমাত্র স্থায়ী রাসায়নিক উপাদান। এটিই বংশগতির ধারক ও বাহক।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ডিএনএ প্রকৃত জেনেটিক বস্তু। এটি দেখতে সুতার মতো, কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম। বিজ্ঞানীদের মতে, মানব ডিএনএর প্রায় ১.৫ শতাংশজুড়ে জিনের অবস্থান। প্রতি নিউক্লিয়াসে প্রায় ২০ হাজার প্রোটিন উত্পাদক জিন থাকে। এসব জিনের প্রতিটিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জৈব রাসায়নিক সংকেত। প্রতিটি জিনের কোনোটিতে না কোনোটিতে রয়েছে জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যের পরিস্ফুটন, যা বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এক বা একাধিক জোড়া জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের (এইচজিপি) বিজ্ঞানীরা প্রথম মানুষের জিনবিন্যাস উন্মোচন করেন। ২০০০ সালের জুনে প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হয় এ নকশার খসড়া। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্প তাদের প্রথম মানব জিনোম নেচার জার্নালে প্রকাশ করে। এক দিন পর সায়েন্স জার্নালে মানব জিনোম প্রকাশ করে সেলেরা জিনোমিক্স।
মানব জিনবিন্যাস উন্মোচন হলেও এর বিশ্লেষণ জটিল, দুর্বোধ্য ও সময়সাপেক্ষ। এ বিশ্লেষণ জানা গেলে কোনো ব্যক্তি তার দেহের রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যক্তিগত ওষুধ ব্যবস্থাপনা নিতে পারেন। অর্থাৎ, কোনো রোগীর জিনবিন্যাস অনুযায়ী রোগ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা যাবে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্যানসারের মতো কোনো জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না, তা-ও জানা যায়। এ ছাড়া বংশগতভাবে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মে কোনো রোগ যেতে পারে কি না, তা-ও আগাম জানা যাবে।
অদূর ভবিষ্যতে মানুষ এর সুফল ভোগ করবে—এ প্রত্যাশায় মানব জিনবিন্যাস নিয়ে গবেষণা চলছে। মানুষের না হলেও গবাদিপশু ও ফসলের জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনবিন্যাস উন্মোচনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে সাড়া ফেলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম। তিনটি ফসল, চারটি জীবাণুসহ ১৯টি জীবের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তিনি পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার এবং বাংলাদেশের হয়ে পাট ও পাটের ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও চীনের বেইজিং জিনোম ইনস্টিটিউটের (বিজিআই) বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে বিশ্বে সর্বপ্রথম মহিষের পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সে উন্মোচন করেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে এসেছে আরেক সাফল্য। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা যৌথ গবেষণায় গমের ‘ব্লাস্ট’ রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনে সফল হয়েছেন। এতে বাংলাদেশে ছত্রাকটির উত্স, সবলতা ও দুর্বলতা জানার সুযোগ তৈরি হলো। এখন ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন তাঁরা।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ইরির বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮৯টি দেশের প্রায় তিন হাজার প্রজাতির ধানের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন ও উন্মোচন করেছেন। সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
আশার কথা, এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৮৩টি ধানের জাত রয়েছে। শিগগিরই কৃষকেরা ধানের জিনোম সিকোয়েন্স প্রযুক্তির সুবিধা পাবেন বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইরির জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবক দলের সদস্য ও রুশ বিজ্ঞানী নিকোলাই আলেকসানড্রাইভ বলছেন, এ আবিষ্কারের মাধ্যমে শস্যে মানুষের শরীরের চাহিদামাফিক বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সংযোজন বা বায়োফর্টিফিকেশন করা অধিকতর সহজ হবে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ, পোকামাকড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও ঠান্ডা সহনশীল জাত উদ্ভাবন আরও ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণকারী শস্যটির বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। আরেকটি সবুজ বিপ্লবের দুয়ার খুলে দেবে বিজ্ঞানীদের এই অসামান্য উদ্ভাবন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৯
আপনার মতামত জানানঃ