তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানকে উদ্দেশ করে অপমানজনক মন্তব্য করায় দেশটির এক নারী সাংবাদিককে আটক করেছে দেশটির পুলিশ। শনিবার সেদেফ কাবাস নামের ওই সাংবাদিককে আটক করা হয়। ইস্তাম্বুলের একটি আদালত বিচারকাজ শুরুর আগপর্যন্ত তাকে কারাগারে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। রোববার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম এএফপি।
বিরোধী দলের একটি টিভি চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে এরদোয়ানকে উদ্দেশ করে খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ বলেন সেদেফ কাবাস। টিভি চ্যানেলের ওই লাইভ শোতে সাংবাদিক সেদেফ কাবাস বলেন, বিখ্যাত একটি প্রবাদ রয়েছে—‘রাজমুকুটধারীরা জ্ঞানী হন’। তবে এটি সত্য নয়। টেলি ওয়ান চ্যানেলকে সাংবাদিক সেদেফ কাবাস আরও বলেন, ‘রাজপ্রাসাদে ষাঁড় ঢুকলে রাজা হতে পারে না; বরং প্রাসাদটাই গোয়ালঘর হয়ে যায়।’
সংবাদমাধ্যম এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় শনিবার রাত ২টায় সাংবাদিক সেদেফ কাবাসকে আটক করে পুলিশ। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেন এবং পরে সেটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টুইটারে পোস্ট করেন। টুইটারে তার ৯ লাখ অনুসারী রয়েছেন। পরে আদালতে হাজিরের পর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
প্রেসিডেন্টকে অপমান বা অপমানজনক মন্তব্য করা তুরস্কের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। বর্তমান আইন অনুযায়ী, তুরস্কে এ ধরনের অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এক থেকে চার বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তবে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রধান মুখপাত্র ফাহরেতিন আলতুন সাংবাদিক সেদেফ কাবাসের মন্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে অভিহিত করেছেন।
ফাহরেতিন আলতুন টুইটারে বলেন, ‘তথাকথিত এক সাংবাদিক টেলিভিশন চ্যানেলে নির্লজ্জভাবে আমাদের প্রেসিডেন্টকে অসম্মান করেছেন। বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া এই সাংবাদিকের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।’
আলতুন আরো বলেন, আমি অভিযুক্ত ব্যক্তির ওদ্ধত্য ও অনৈতিকতার তীব্র নিন্দা জানাই। এ ধরনের মন্তব্য শুধু অনৈতিকই নয়, এটি দায়িত্বহীনতার পরিচয়ও।
আদালতে দেওয়া বিবৃতিতে সেদেফ কাবাস প্রেসিডেন্টকে অবমাননা করার কথা অস্বীকার করেন।
লি ওয়ান চ্যানেলের সম্পাদক মার্ডান ইয়ানারডাগ সাংবাদিক সেদেফ কাবাসকে আটক করার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, একটি প্রবাদ বলার কারণে রাত দুইটার সময় তাকে আটক করা মেনে নেওয়া যায় না। এটি সাংবাদিক, গণমাধ্যম ও সমাজের জন্য হুমকি।
একটি প্রবাদ বলার কারণে রাত দুইটার সময় তাকে আটক করা মেনে নেওয়া যায় না। এটি সাংবাদিক, গণমাধ্যম ও সমাজের জন্য হুমকি।
জানা গেছে, তুরস্কের সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কাবাসের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ‘বাক-স্বাধীনতার ওপরে মারাত্মক আঘাত’ বলে দাবি করেছে। অধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলো অবশ্য সাংবাদিকদের আটকের মাধ্যমে তুরস্ক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করছে বলে বরাবরই অভিযোগ করে আসছে।
২০১৪ সালের আগস্টে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। এর আগে ১১ বছর তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এরদোয়ানকে অবমাননা করায় কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। রয়টার্সের খবর বলছে, গত বছর এ ধরনের ৩১ হাজারের বেশি অভিযোগের তদন্তকাজ চলেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের তালিকা অনুযায়ী, স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে তুরস্কের অবস্থান ১৫৩তম।
তুরস্কে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ওপর কড়া নজর রাখা হয়। এরদোয়ান বা তার মন্ত্রীদের অপমান করার দায়ে অথবা বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলার সমালোচনা করায় অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত এক দশকে তুরস্কের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের অধিকাংশই সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। ফলে সমালোচকদের মন্তব্য করার এবং নিরপেক্ষ সংবাদ তুলে ধরার জন্য জায়গা করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তুরস্কের সংসদ একটি আইন পাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই আইন বাকস্বাধীনতার প্রতি বড় হুমকি।
এই আইনের আওতায় সামাজিক মাধ্যমের যেসব প্ল্যাটফর্মের দশ লাখের বেশি অনুসারী আছে, তাদের তুরস্কে স্থানীয় কার্যালয় থাকতে হবে এবং সরকার কোন কন্টেন্ট সরাতে বললে তাদের সেটা মানতে হবে।
কোন সংস্থা এই নির্দেশ অমান্য করলে তাদের জরিমানা করা হবে এবং তাদের ডেটা সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ তাদের ডেটা সরবরাহের গতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়া হবে।
এই পরিবর্তন প্রযোজ্য হবে ফেসবুক, গুগল, টিকটক এবং টুইটারের মত বিশাল প্রযুক্তি সংস্থাগুলোসহ বিভিন্ন কোম্পানি এবং সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে।
নতুন ইন্টারনেট আইনের ফলে পুলিশের সাথে সরকারের একযোগে কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং তারা অনলাইনে সেন্সরশিপ চালাতে পারবে। এর ফলে যারা ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে ইতোমধ্যেই সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে এবং সরকার যাদের নির্দয়ভাবে লক্ষ্যবস্তু করেছে তাদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৩০
আপনার মতামত জানানঃ