এক ধনীর হাতে এত টাকা যে এক কেজি চাল ১০০০ টাকা হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু এক কেজি চাল বাজারে আনতে পারলেই ১০০০ টাকা পাবে জেনেও কৃষক বাজারে আসতে পারছে না ৫০০ টাকা পরিবহন ভাড়া নেই বলে।
এটাই বাংলাদেশের অর্থনীতি। এখানে বিশ্বের তাবত অর্থনীতিবিদের সূত্র ফেল মেরেছে। এখানে টাকার ডি-ভ্যালুয়েশন গোপনে হয়। জনগণ শুধু জানে ৮৫ টাকার ডলার এখন ৯২ টাকা। তাও মিলছে না। শেয়ার বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য উপচে পড়ছে। সেভিংস একাউন্টেও সুদ পাওয়া যাচ্ছে না। ইনভেস্টমেন্ট করতে ২৮ টি দপ্তরের লোকজন হাঙ্গরের মত হা করে আছে। ঘুষ-দুর্নীতি প্রকাশ্য এবং ‘বৈধ’। খোদ ‘দুদক’এর লোকজন দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত। বিশ্ববাজারে তূলোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ফলে আমদানিকৃত সূতো-কাপড়েরও দাম বেড়েছে। আর তারই ফলে বায়ারদের ধরে দেওয়া আগের ‘সি-এম’-এ লাভ থাকছে না। কম্পোজিট নয় যে কারাখানাগুলো তারা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এক এপেক্স বন্ধ হয়ে ৪০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। মাত্র ১০০ কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়নি সরকার। অথচ পদ্মায় আর কর্ণফূলীতে টানেল নির্মিত হচ্ছে! এর অর্থ ইটালিয়ান মার্বেলের ফ্লোর, পার্শিয়ান কার্পেট, ফরাসী ফার্নিচার আর জামান টেকনোলজির ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে কোনও টয়লেট বানানো হয়নি।
প্রতিটি শহরে একটার পর একটা ফ্লাইওভার, মেট্রো, বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, শহরে শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ, ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, ব্রিজ-কার্লভাট নির্মাণ, রিকসা-অটো-ঠেলাগাড়ি-পানদোকানসমেত সুপার হাইওয়ে নির্মাণ, রংবেরঙের রিসোর্ট নির্মাণ আর সামরিক-বেসামরিক আমলা, মন্ত্রী-সাংসদদের তেল চকচকে প্রোফাইলই উন্নয়ন নয়।
আপনাদেরকে বিশ্বব্যাংক প্রেসক্রিপশন দিল- আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশ হবে। গত জানুয়ারির রিপোর্টের তুলনায় যা ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ওমনি আপনারা ধরে নিলেন চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। আপনারা আরও একটু আগবেড়ে- চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ ও আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ফেললেন।চূড়ান্ত বিচারে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন বোঝা সম্ভব নয়।
জিডিপি কী? কোনও একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, যা জিডিপি নামে পরিচিত)। জিডিপি’র ধারণা কোত্থেকে এলো? মার্কিন অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেতসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাশিয়াতে। ১৯২২ সালে পরিবারসহ চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি বের করার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেসের কাছে ‘ন্যাশনাল ইনকাম ১৯২৯-৩৫’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। সেই থেকে শুরু। সাইমন কুজনেতস এই মৌলিক কাজের জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পান ১৯৭১ সালে।
কিন্তু ওয়েলফেয়ার স্টেট বা একটি কল্যাণমুখি দেশের জিডিপির ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন কল্যাণমুখি রাষ্ট্রের অর্থনীবিদগণ এবং রাষ্ট্র পরিচালকগণ। যেমন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটান। তারা GDP নির্ণয় করে তাদের নিজেদের মত করে। আর সেটা সর্বোতভাবে জনকল্যাণকর।
অথচ সাইমন কুজনেতসের ধারণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমাদের দিগগজ অর্থনীবিদরা আমাদের এখানে ব্যয় করতে পারলেই জিডিপি বৃদ্ধি পাবে বলে রকেট-সায়েন্স আবিষ্কার করে ফেললেন! ধরুন, একটা প্রকল্প করতে লাগে ৫ কোটি টাকা। পারস্পরিক যোগসাজশে সেটা ৫০ কোটি টাকা বানিয়ে ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেও সমস্যা নেই। জিডিপি তাতে বাড়বে।
কিন্তু ওয়েলফেয়ার স্টেট বা একটি কল্যাণমুখি দেশের জিডিপির ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন কল্যাণমুখি রাষ্ট্রের অর্থনীবিদগণ এবং রাষ্ট্র পরিচালকগণ। যেমন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটান। তারা GDP নির্ণয় করে তাদের নিজেদের মত করে। আর সেটা সর্বোতভাবে জনকল্যাণকর।
এই উল্লেখযোগ্য বিকল্পটি হাতে কলমে ব্যবহার করছে ভুটান। ভুটানে রাষ্ট্রীয়ভাবে জিডিপি বা ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ এর বদলে মাপা হচ্ছে ‘গ্রস ন্যশনাল হ্যাপিনেস’ বা ‘জিএনএইচ’।
শান্তিপ্রিয় দেশ ভুটানের প্রধান মনোযোগ তার মানুষের দিকে। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের ধারণাটি নিয়ে প্রথম কাজ করেন সিকো মানশোল্ট নামের ডাচ রাজনীতিবিদ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত এই রাজনীতিবিদের ধারণাটি তেমন প্রচার পায়নি যদিও। তবে ইউরোপজুড়ে জিডিপির পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ এইসব সূচক ব্যবহার করা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়।
১৯৭২ সালে ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিনগিয়ে ওয়াংচুক ভুটানের উন্নয়নের ফলে যাতে মানুষের সুখ না কমে সেই ব্যাপারে আলোকপাত করেন। অর্থাৎ তখন থেকেই ভুটানের রাজনীতি আর অর্থনীতিতে এই গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের ধারণার আত্মীকরণ ঘটে। এবং ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটি ভুটানের সংবিধানের অংশ করা হয়। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের এই ধারণা প্রধান চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই চারটি স্তম্ভ হলো, টেকসই এবং সমতাভভিত্তিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশের সুরক্ষা, নিজেদের সংস্কৃতির সুরক্ষা -প্রচার এবং সুশাসন।
যখন এসব নিয়ে লিখতে যাই তখন আমাদের দেশের গণতন্ত্রহীনতা, ভোটবিহীন নির্বাচন, সমতাভিত্তিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, সংস্কৃতির সুরক্ষা, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা আর সুশাসনের বিষয়গুলো আয়নায় মুখ ভেংচি দেয়। একটা দেশ কীভাবে দিনের পর দিন ক্রমশঃ অধঃপতিত হয়ে পড়ছে ভাবলে বিবমিষা জাগে। মনে হয় একেবারে সহায়সম্বলহীন, প্রাকৃতিক সম্পদহীন, সম্ভবনাহীন, আশাহীন ফকির হলেও তবুও মনকে প্রবোধ দেওয়া যেত।আমাদের যে ভূটান হওয়ারও যোগ্যতা নেই!
মনজুরুল হক
৩১ অক্টোবর, ২০২১
আপনার মতামত জানানঃ