ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিতে ঘটে গেছে ট্র্যাজেডি। গত ৭ জুলাই মধ্যরাতে কিছু অস্ত্রধারী হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসির পোর্ট অব প্রিন্সের বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যা করে। এতে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন। পুলিশের গুলিতে চার সন্দেহভাজন নিহত হয় এবং পরে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবেশী দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিক হাইতির সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ড দেশটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে।
একসময় হাইতি ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ, তখন চিনি ও কফি শিল্পের রমরমা অবস্থা ছিল। সেই হাইতি এখন পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম রাষ্ট্র। ২০১০-এর ভূমিকম্পে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং একই সঙ্গে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০১৬ সালে হারিকেন ম্যাথিউ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। তাছাড়া কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে কাহিল হাইতির জনগণ। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারি দেশেটির স্বাস্থ্য খাতের আরো বেহাল দশা করেছে।
হাইতির বিভিন্ন হাসপাতালে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় হাজার হাজার নারী ও শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ স্থানীয় সময় রোববার এ সতর্কবার্তা দেয় বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়ে আসছে। দেশটিতে একের পর এক অপহরণের ঘটনা বিশেষ করে চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একদল মিশনারি অপহৃত হওয়ার পর এ সমস্যা চরম আকার ধারণ করে।
হাইতির পরিবহন শিল্পের নেতাদের ভাষ্য, অপহরণের ঘটনা অনেক বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি সরবরাহ করা চালকদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অপহরণ বা মালপত্র ছিনতাই হতে পারে— এ ভয়ে তারা জ্বালানি আগের মতো সরবরাহ করছেন না।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স ও হাইতির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপদ্বীপের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে জ্বালানি সরবরাহ করতে স্থানীয় এক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি।
হাইতিতে ইউনিসেফের উপপ্রতিনিধি রাউল ডি টরসি এক বিবৃতিতে জানান, ‘দেশটির হাসপাতালে অনেক গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জ্বালানি ঘাটতির কারণে ওই সব হাসপাতাল নারী ও শিশুদের ঠিকমতো লাইফ সাপোর্ট দিতে পারছে না।’
বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় হাইতির বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য ডিজেল চালিত জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে হয়।
জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হাইতির প্রধান মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তাদের সেবা বন্ধ করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির শিল্প-কারখানার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে হাইতি সরকারের তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এগুলো ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতির জন্য নতুন কিছু নয়। সন্ত্রাসীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে হাইতির ক্রমিক সংকটে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।
হাইতির রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাস অবশ্য নতুন নয়। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাঁসোয়া ডুভালিয়ে ও তার ছেলে জ্যঁ ক্লোদ ডুভালিয়ের শাসনামল শেষ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে বহুবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে চরম দারিদ্র্য এবং সন্ত্রাস। শুধু চলতি বছরেই ক্রিমিনাল গ্যাংদের কারণে সেখানকার হাজার হাজার মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইউনিসেফে হাইতির প্রতিনিধি ব্রুনো মাস গত জুন মাসে হাইতির পরিস্থিতিকে গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হাইতির ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক পিয়ের এসপেরাঁস জানিয়েছেন, দেশটির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিভিন্ন ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ চলে। এসব গ্যাং প্রায়ই পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়।
হাইতিতে অস্থিরতার মধ্যেই ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মইসি দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সময় মোটেই ভালো কাটেনি। তাকে নানামুখী ঝঞ্ঝা, বিক্ষোভ, বিরোধিতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়।
মইসির বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অপশাসন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মইসি ব্যর্থ বলে বিরোধীরা অভিযোগ তোলে। তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট নির্বাচন বিলম্বিত করার অভিযোগ আনা হয়। তিনি সংবিধানে পরিবর্তন এনে আরেক দফায় প্রেসিডেন্ট হতে চান বলেও সন্দেহ করা হচ্ছিল। এসব অভিযোগে হাইতিতে মইসির বিরুদ্ধে দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়ে আসছিল।
গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ব্যাপক সহিংস রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা তার ক্ষমতার মেয়াদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে। তারা তার পদত্যাগ দাবি করে। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় এক বছর ধরে ডিক্রি দিয়ে দেশ চালাচ্ছিলেন মইসি।
মইসির পাঁচ বছরের প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি শেষ বলে দাবি করে বিরোধীরা। কিন্তু মইসি দাবি করেন, জটিলতার কারণে তিনি ঠিক সময়ে ক্ষমতায় বসতে পারেননি। এক বছর পর ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। তাই তার মেয়াদ আরও এক বছর আছে। দুই পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইতির রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়।
বিরোধীরা যেদিন মইসির ক্ষমতাকাল শেষ বলে দাবি করে তার পদত্যাগ চায়, ঠিক সেদিনই (৭ ফেব্রুয়ারি) তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে গুরুতর এক অভিযোগ তোলেন। তিনি তার সরকার উৎখাত ও তাকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার অভিযোগ আনেন। কথিত অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ধরপাকড় শুরু করেন তিনি। ধরপাকড়ের এই তালিকায় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও ছিলেন।
মইসির শাসন অবৈধ উল্লেখ করে বিরোধীরা তাদের পছন্দসই অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করে। অন্যদিকে মইসিও ক্ষমতায় থাকতে অনড় থাকেন। এমন সংকটকে হাইতি গণমাধ্যম ‘দুই প্রেসিডেন্টের’ যুগ বলে বর্ণনা করে।
মইসি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিন্দা জানিয়েছে। সংকট নিরসনে হাইতিকে সহায়তা করার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সংকট থেকে হাইতি খুব দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্তত ইতিহাস সে কথাই বলে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ