ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক ও সরকারের প্রশ্রয়ে নানা অন্যায় অনিয়ম ও নির্যাতনের পারদের বৃদ্ধিতে একদিকে কথা বলার, প্রতিবাদ করার নানা রসদ জন্ম নিচ্ছে, অন্যদিকে কথা বলাবিরোধী বিভিন্ন আইন করে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তেমনি একটি আইন— ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সরকার বিরোধী কোনো কথা বা শিল্পকর্মকেই এই আইনের অধীনে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করে নানা নির্যাতনের মাধ্যমে উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই আইনকে মূলত সরকার নিরাপত্তা আইন বলে মানতে চান। কেননা, এই আইনের অধীনে এ পর্যন্ত যত মামলা, আটক ও গ্রেপ্তার হয়েছে তার প্রায় সবকটাই সরকারের সমালোচনা করার প্রেক্ষিতে।
সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামি, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সুইডিশ-বাংলাদেশি সাংবাদিক তাসনিম খলিল, বিএলই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডার-পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন, রাজনৈতিক-নাগরিক সংগঠন রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম, আশিক ইমরান এবং স্বপন ওয়াহেদ— এই সাতজনের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো এবং সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ গ্রহণ করেছে ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনাল এবং তাদের গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এই ছয় জনের মধ্যে কিশোর, মিনহাজ এবং দিদারুলকে এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তারা এখন জামিনে আছেন। এছাড়া অন্যদের পলাতক দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামির মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি স্টেটওয়াচকে বলেন, ‘বায়বীয় ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট এতটাই একতরফা যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭,০০০ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় কেবল সরকার সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা করার জন্যে তার খেসারত হিসেবে আমাকে একটি মামলা খেতে হয়েছে। এটাকে অনেকটা এভাবে তুলনা করা যায়, ধরুন শীতে আপনি কাঁপছেন কিন্তু এক গুরুগম্ভীর ব্যক্তি আপনাকে বললো ওই যে দূরে আগুনটা জ্বলছে তার দিকে তাকিয়ে থাকো গা গরম হয়ে যাবে’!
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার পরিবার নাকি আজন্ম গনতন্ত্রের চর্চা করে এসেছেন, এই কি সেই গনতন্ত্র যে আপনাদের তিরস্কার করে কার্টুন আঁকলে বা সমালোচনা করলে আপনারা মানুষদের ধরে গুম করবেন? বাগে পেলে পিটিয়ে কান পচাবেন বা জেলে রেখে অত্যাচার করে তিলে তিলে মারবেন’?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেছেন। আসামিরা ‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুক পেজে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়েছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাসনিম খলিল, সায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মামলায় তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আল জাজিরা টেলিভিশন প্রতিবেদন প্রচার করে। সেখানে তুলে ধরা হয়, সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের তিন ভাই বাংলাদেশে খুন, হত্যা ও মানিলন্ডারিংয়ের সাথে যুক্ত, আর তার প্রশ্রয় দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি জেনারেল আজিজ আহমেদ।
‘প্রধানমন্ত্রীর সকল লোক’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যে, হারিস ও আনিস আহমেদ, দুজনেই হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া তাদের ভাই, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগ থেকে বাঁচতে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরে কীভাবে তাদের সুরক্ষা দিচ্ছেন। জাল পাসপোর্ট কিভাবে ভুয়া দলিল দিয়ে করা হয়েছে, এগুলোর প্রমান দেখিয়েছে আল-জাজিরা।
তাদের ভাই হলেন জেনারেল আজিজ আহমেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসী।
আল জাজিরার এই অনুসন্ধানে মূলত সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যদের অতীত এবং বর্তমান বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয় এবং নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়।
আল জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাই-এর কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।
সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল। এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। যদিও দুই ভাই হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক, কিন্তু আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক আসামি হলেও জেনারেল আজিজ আহমেদের ছেলের বিয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিসহ আইনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের দেখা গেছে।
তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন।
আল-জাজিরার এই প্রতিবেদনের অনুসন্ধানী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন জুলকারনাইন সায়ের (সামি)।
স্টেটওয়াচকে তিনি বলেন, ‘কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের দেশের রাস্ট্রপতি ক্ষমা করা দিচ্ছে, এ যেন একটা তামাশা, আপনারা আমাদের দেশ ও জনগনের ভাগ্য নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন কিন্তু আপনাদের কিছুই বলা যাবে না! বললেই অত্যাচার, মামলা, গুম বা ক্রস ফায়ারের আদেশ জারী হবে’!
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী স্বৈরাচারীদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে বাংলাদেশীদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলও পারবেনা। কোন মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা খুনী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে আমাকে বা আমার মত যারা আছেন তাদের রাশ টেনে ধরা যাবেনা’।
আপনার মতামত জানানঃ