কর্মজীবী নারী পরিচালিত এক জরিপে থেকে জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে ৭২ শতাংশ নারী শ্রমিক মৌখিক হয়রানির এবং ৬২ শতাংশ নারী শ্রমিক মানসিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
২০১৯ সালে ‘তৈরি পোশাক কারখানায় নারীবান্ধব ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ’ সংক্রান্ত এক গবেষণা পরিচালনা করে কর্মজীবী নারী। এই জরিপে ৩২৭ টি পোশাক কারখানার ৩ হাজার ১৪ জন নারী শ্রমিক অংশ নেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ২১ শতাংশ নারী শ্রমিক শারীরিক হয়রানির এবং ১৪ শতাংশ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
সম্প্রতি ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও শ্রম আইনের সংশোধন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এই জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়।
কর্মজীবীর নারীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অ-প্রাতিষ্ঠানিক উভয়খাতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও কর্মস্থলে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায় নি, প্রতিরোধ করা যায়নি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি।
অথচ আমরা জানি, কর্মক্ষেত্রে যেকোনো ধরণের যৌন হয়রানি মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা।
পোশাক শিল্পের মতো প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের এই চিত্র থেকে অনুমান করা যায়, অ-প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ, কারণ তাদের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনো আইনি কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, কর্মক্ষেত্রে নারীশ্রমিকের প্রতি সহিংসতা, হয়রানি এবং বৈষম্য একটি চলমান সমস্যা হলেও এই ঘটনাগুলো প্রায়ই প্রকাশিত হয় না। কারণ দরিদ্র নারীশ্রমিকরা আশঙ্কা করেন যে, তারা সহিংসতা ও হয়রানি বিষয়ে অভিযোগ করলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা থাকবে না।
কর্মজীবী নারী বলছে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রম আইনের সংশোধন করা হবে নাকি কর্মক্ষেত্রে হয়রানি প্রতিরোধে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হবে; এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ঠ নীতিমালা ঠিক করা আজ সময়ের দাবি।
কারণ কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী পুলিশও। গত বছর কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১০ শতাংশ নারী পুলিশ নিজেদের কর্মস্থলে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে মধ্যপর্যায়ের দুই দশমিক সাত শতাংশ, সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ে তিন দশমিক তিন শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি কনস্টেবল পর্যায়ে।
অ্যাকশন এইডের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক কারখানাতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ নারী পরিবহন চলাচলের সময় মৌখিক, দৈহিক এবং অন্য যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হন। এছাড়া প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রধান যৌন আক্রমণকারীরা ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষ।
এর আগে করোনা মহামারিকালীন প্লান ইন্টারন্যাশনাল ও গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের সহায়তায় এক জরিপ পরিচালনা করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম।
গবেষণার জন্য নমুনা হিসেবে ২০টি প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে তথ্য সংগ্রহকারী দলের মাধ্যমে জরিপ কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৩৯০ জন নারীর একটি তালিকা তৈরি করা হয় (র্যান্ডম স্যাম্পলিং)। পরবর্তীতে এই জরিপটিতে যৌন হয়রানি শিকার হয়েছেন এমন ১৩৫ জন কর্মজীবী নারী অংশগ্রহণ করেন।
অংশগ্রহণকারী ১৩৫ জন নারীর শতভাগই নিজ কর্মস্থলে কোনও না কোনও ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে জানান। তাদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ২/৩ বার, ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ নারী ৪ থেকে ৫ বার এবং ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ নারী একবার করে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
১৩৫ জনের মধ্যে ৬১ জন শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে (৪৫ দশমিক ১৯ শতাংশ), ৮০ জন মৌখিকভাবে (৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশ), সরাসরি যৌন আবেদনের শিকার হয়েছেন ৬৪ জন অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী। এছাড়া ৬০ জন (৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ) সুপারভাইজার দ্বারা, ৮৮ জন (৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ) ম্যানেজার/বস কর্তৃক, ৮ জন (৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ) নারী তাদের নিয়োগকর্তার দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জরিপে বলা হয়, উত্তরদাতাদের একটি বড় অংশ অর্থাৎ ৮৯ জন জানেনই না কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বা এ সম্পর্কে হাইকোর্টের একটি গাইডলাইন আছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মধ্য থেকে ১১৮ জন (৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ) মনে করেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি সমন্বিত আইন প্রয়োজন। শতকরা ৮৫ দশমিক ১৯ নারী বলছেন, আইন হলেই হবে না; এটি যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মস্থলে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হলেও চাকরি হারানো ও লোকলজ্জার ভয়ে তারা বেশির ভাগ সময় চুপ থাকেন বা প্রতিবাদ করেন না। আবার কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও অনেক সময় নতুন করে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। এছাড়া ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে বিভিন্ন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ যৌন হয়রানির ঘটনা চেপে রাখতে চায়।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দ্রুত বিচার করে শাস্তি দৃশ্যমান করা জরুরি। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। কেউ নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। কারণ যৌন নির্যাতন এখনই থামানো না গেলে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কেবল পোশাক খাতে নয়, অন্য খাতেও কমে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ