বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে মাদকের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বাড়ছে। কয়েকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আর্থিক নিরাপত্তা ভোগ করা পেশাজীবী নারীদের অনেকেই ঝুঁকছেন মাদকের দিকে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে মাদকসেবী কিশোরীর সংখ্যা। গৃহবধূরাও হচ্ছেন মাদকাসক্ত।
ঢাকা আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৪০ জন নারী মাদকসেবী। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ১২৫ জন, গৃহিণী ১৫১ জন, চিকিৎসক তিনজন, সাইকোথেরাপিস্ট একজন, বেসরকারি চাকরিজীবী ১৭ জন, শিক্ষক তিনজন, মডেল পাঁচজন, যৌনকর্মী চারজন, বেকার ১৬ জন, ব্যবসায়ী ১০ জন, ডিজে একজন এবং এয়ারহোস্টেস তিনজন।
কোন পেশার নারীরা মাদকাসক্ত বেশি?
নিউজবাংলার সূত্র মতে ঢাকা আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর মমতাজ খাতুন বলেন, ’আমাদের এখানে যারা আসছেন তাদের বড় অংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের স্টুডেন্ট। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছেন গৃহবধূ। আমরা চিকিৎসা পেশায় জড়িতদেরও পাচ্ছি। সেই সঙ্গে আছেন মডেল, অভিনেত্রী, এয়ার হোস্টেস।’
নারীদের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে চিকিৎসা পেশায় জড়িতদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক বলে জানান মমতাজ খাতুন। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে আসা ডাক্তাররা ড্রাগ নিতে নিতে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাদের ট্রিটমেন্ট দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। তাদের শরীরের সব জায়গায় ইনজেকশনের ছিদ্র। ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নেয়ার উপায়ও থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরে আমরা চারজন ডাক্তার পেয়েছি। তার মধ্যে তিনজন মাল্টি ড্রাগ ইউজার। প্যাথেডিন, আইস, ইয়াবা, গাঁজা সব ধরনের ড্রাগ নিতেন তারা। এই তিনজন তিন মাস চিকিৎসা নিয়েছেন। আর একজন শুধু প্যাথেডিন ইউজার। তিনি খুব ভালো ফ্যামেলির এবং নামকরা একটি হাসপাতালের মালিকের মেয়ে। মেয়েটি নিজেও একজন ভালো মেডিসিন স্পেশালিস্ট।’
শুধু আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়, সারা দেশের ৩৬১টি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণকারী নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রে মোট শয্যা রয়েছে ৪ হাজার ৭২৬টি। এসব কেন্দ্রে সচ্ছল পরিবারের রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে সম্প্রতি চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরা এক নারী চিকিৎসক বলেন, ‘চিকিৎসকদের মধ্যে ড্রাগ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। অনেকেই বিষয়টি ম্যানেজ করে চলেন। আমিও প্রথমে সেভাবে চলছিলাম। তবে একটা সময়ে সেটা আর সম্ভব হয়নি। এরপর চিকিৎসা নিয়ে আমি এখন অনেকটা ভালো।’
তিনি বলেন, ‘ডাক্তারদের তো ড্রাগ সম্পর্কে আইডিয়াটা অনেক বেশি। ওরা জানে কোন মাত্রায় কতদিন নিলে আমি ঠিক থাকতে পারব। আবার কোন মাত্রায় কতদিন বিরত রাখতে পারব। ডাক্তাররা অনেকে প্যাথেডিন নেয়, প্যাথেডিনের পর ন্যালবান ইনজেকশন নেয়, এরপর ন্যালবানের বিকল্প কী আছে সেটাও তারা জানে।’
প্যাথেডিন আর ন্যালবান একই গ্রুপের ড্রাগ। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘প্যাথেডিন মূলত সিনথেটিক ব্যথানাশক। কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে বলে এটা সিনথেটিক। এটা সিজারিয়ান বা যেকোনো ধরনের অপারেশনের ক্ষেত্রে ব্যথানাশক হিসেবে চিকিৎসকেরা ব্যবহার করেন। মরফিন, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিন, বিটুইনাফিন, ন্যালবান, ওমাসন এ সবই একই গোত্রের।
‘তবে এগুলোর মধ্যে একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কিছু সরাসরি গাছ থেকে হয়। কতগুলো গাছ থেকে আসার পর কারখানায় প্রসেস হয়। আবার কোনোটা কারখানায় উৎপাদন হয়, যেমন প্যাথেডিন। এগুলোর কার্যকারিতা কমবেশি একই ধরনের।’
ওই নারী চিকিৎসক মাদকে আসক্ত হয়ে নিরাময় কেন্দ্রে যাওয়া আরেক চিকিৎসকের বিষয়েও তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ওই ফিমেল ডক্টর আমার পরিচিত। মাদক নিয়ে যখন তার আলটিমেট পজিশন হলো, তখন পরিবারকে বলল আমার চিকিৎসা দাও। বাসায় থাকলে সে হয়তো সুইসাইড করত বা এমন কোনো শারীরিক সমস্যায় পড়ত যেখান থেকে সে আর হয়তো সাসটেইন করতে পারত না। এমন আলটিমেট পর্যায়েই সবাই চিকিৎসা নিতে আসে।’
আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার উম্মে জান্নাত বলেন, ‘ডাক্তারদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে নানা ধরনের ড্রাগ নিতে নিতে অনেকের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। কেউ কেউ শরীরে এত বেশি ছিদ্র করে ফেলেন যে শারীরিক চেকআপের জন্য আমরা রক্ত নেয়ার ভেইন খুঁজে পাই না। মানে তাদের চিকিৎসা দেয়ার মতো অবস্থাও থাকে না। অনেক সময় ইনজেকশন পুশ করার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।’
রাজধানীর একাধিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে বেশ কয়েকজন নারী এয়ার হোস্টেসের মাদকাসক্তির তথ্যও পাওয়া গেছে।
চিকিৎসা নিয়ে ছয় মাস আগে বাসায় ফিরেছেন এমন একজন এয়ার হোস্টেস বলেন, ‘অনেক সময় কেবিন ক্রুরা কমপিটিশনে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়েন। দেখা যাচ্ছে কারও শরীর খুব বেশি স্লিম, এ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় হতে হয়তো একটু মোটা হওয়া দরকার। এই পরিবর্তন আনতে খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েও অনেক সময় কাজ হয় না। তখন কেউ কেউ ড্রাগের সাহায্য নেন।
‘আবার লং ফ্লাইটে অনেক বেশি ডিউটি থাকে বলে নিজেকে ফিট রাখতে কেউ কেউ ড্রাগ নেন। প্রথম দিকে নিজেকে খুব উৎফুল্ল মনে হয়। তবে এক দিন, দুই দিন, পাঁচ দিন, দশ দিন নিতে নিতে ড্রাগের প্রতি আসক্তি জন্মে যায়। ড্রাগ বলতে আইস নেয়া হয় বেশি। ইয়াবাও চলে কোনো কোনো সময়।’
তিনি বলেন, ‘ড্রাগ নেয়া শুরুর সময়ে মনে করা হয় এতে ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে বা মানসিক ক্ষেত্রে উপকার হবে। তবে একপর্যায়ে সহজে আর ফিরে আসা যায় না।’
মাদকাসক্তির কারণে গত এক বছরে তিনজন মডেল চিকিৎসা নিয়েছেন আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
তাদের মধ্যে একজন উঠতি মডেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি ইয়াবা নিতাম। একটা পর্যায়ে আর ঘুম আসত না। সবকিছু অসহ্য লাগত। তখন বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ খেতে হতো। এই ঘুমের ওষুধের ডোজও দিনে দিনে বাড়াতে হয়েছে। একটা পর্যায়ে পরিবারকে সব খুলে বলি। তারা আমাকে রিহ্যাবে নিয়ে যায়।
সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর মমতাজ খাতুন বলেন, ‘এমফেটামিন মানে ইয়াবা আসক্তদের বিশেষ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিতে হয়। ইয়াবার কারণে যে শারীরিক সমস্যাগুলো হয় সেটার বিপরীত মেডিসিন খেতে দেয়া হয়।’
মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি পরিবারকে বলে দিয়েছিলাম যে স্টাডির চাপ আর বন্ধুদের প্ররোচনায় ড্রাগ নেয়া শুরু করেছি। এখন ছাড়তে চাচ্ছি। তখন আমাকে পরিবার রিহ্যাবে নিয়ে যায়।’
আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুর্নবাসন কেন্দ্রের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার উম্মে জান্নাত বলেন, ‘শিক্ষিতরা মাদক নিয়ে অনেক কনফিডেন্ট থাকেন। তারা ভেবেই নেন যে এটা ভালোভাবে ম্যানেজ করা যাবে। আমরা ডাক্তারদের মধ্যে প্যাথেডিন নেয়ার প্রবণতা বেশি পেয়েছি। আর অন্যদের মধ্যে আইস, ইয়াবাসহ মেজর ড্রাগগুলো নেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। আমাদের এখানে যেসব রোগী আসেন তাদের বেশির ভাগই ইয়াবা, গাঁজা আর ঘুমের ওষুধে আসক্ত।’
কীভাবে সঙ্কট মোকাবিলা সম্ভব
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘সব পেশার লোকজনের মধ্যে কমবেশি মাদকসেবী আছেন। এটা জেনারালাইজড করা যাবে না। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার।’
মাদকাসক্তির দূর করার চিকিৎসার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিরাময় শব্দটি আমরা বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছি। ১৯৯০ সালের আইনে আছে নিরাময় লিখতে হবে। তবে এটা তো নিরাময়যোগ্য না, চিকিৎসাযোগ্য।
‘আবার চিকিৎসাযোগ্য হলেও অনেকে যতটুকু ট্রিটমেন্ট নেয়া দরকার ততটুকু নেন না। যখন খুব ভালনারেবল পর্যায়ে যান তখন চিকিৎসা নিতে আসেন। তারপর আর খোঁজ থাকে না।’
দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ওপর জোর দিয়ে রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘একবার ওষুধ খেলে কি ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশন ভালো হয়? হয় না। সে রকম এক মেয়াদে তিন মাস ভর্তি থেকে ট্রিটমেন্ট নিয়ে কোনো মাদকসেবী রোগী ভালো হন না। মুক্ত অবস্থায় যদি কেউ ১২ মাস মাদকের বাইরে থাকতে পারেন, তাহলে বলা যাবে মাদকের রোগী ভালো হয়েছেন। তবে বেশির ভাগ ভালো হয় না। ৬০-৮০ ভাগ পুরোপুরি রিকভার হয় না। এটা পুরো বিশ্বব্যাপী ডেটা, শুধু বাংলাদেশের জন্য না।’
এদিকে, নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তির প্রবণতা বাড়ার পেছনে আধুনিক সময় দুর্বল পারিবারিক বন্ধনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে মডেল ভাবতে পারেন না। সন্তান তার প্যারেন্টকে মডেল ভাবার অবকাশ পায় না। কারণ এখনকার অনেক বাবা-মাই তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। এসব পরিবারের মা-বাবার কাছে টাকা ইনকাম করাটা নেশায় পরিণত হয়। আর বাচ্চারা পরিস্থিতির কারণে জড়ায় ড্রাগের নেশায়।
‘শুধু তা-ই নয়, পরিবারের অন্য যেকোনো সদস্যই একে অপরের মডেল হিসেবে নিতে পারে না। এরা মডেল হিসেবে নিচ্ছে বাইরের কাউকে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মাদকে জড়াচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এ প্রবণতা এখন পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি। তারা আবার শিক্ষিত নারী, আর্থিকভাবে সচ্ছল নারী। কারণ ড্রাগ কেনার জন্য পর্যাপ্ত সোর্স তাদের আছে। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা ভয়ানকভাবে বাড়ছে।’
ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘আগে একটা সময় ছিল নারীর পক্ষে টাকা জোগাড় করা অসম্ভব ছিল। এখন সময় পাল্টেছে। নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক বেশি। তাছাড়া পারিবারিকভাবে অনেকে প্রতিষ্ঠিত থাকায় মেয়েরা চাইলেই আর্থিক ব্যাপারে সুবিধা পাচ্ছে। তবে তারা মানসিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা পাচ্ছে না। হতাশা বাড়ছে। এই হতাশা থেকে অনেকে মাদকে জড়াচ্ছে।
‘শো আপ করার টেনডেন্সি আমাদের এখন বেশি। দরদ, শেয়ার বা বোঝাপড়ার টেনডেন্সি কম। নেগেটিভ ইগোটা বেশি হওয়ায় মাদকে জড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ