সরকারের নানা উদ্যোগ কিংবা জিরো টলারেন্সসহ কঠোর নির্দেশনা দিয়েও মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যে পরিমাণ কোকেন, হিরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক আকাশ ও নৌপথে এবং সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে দেশে আসছে তার ৫ শতাংশও উদ্ধার হয়নি।
এই নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে যতটুকু মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়, তা পাচার হয়ে আসার মাত্র ২০ ভাগ। তবে এই দেশে মাদক উদ্ধারের হার শতকরা ৫ ভাগেরও বেশি। এই সর্বনাশা মাদকে ঘরে ঘরে আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মাদক গ্রহণকারী তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ শারীরিক, মানসিকসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি, লিভার, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, স্থায়ীভাবে যৌন ক্ষমতা লোপ পাওয়াসহ নানা রোগে ভুগছে তারা। চিকিৎসকদের মতে আসক্ত তরুণ-তরুণীদের সিংহভাগ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। সর্বনাশা মাদকের কারণে শিক্ষার্থীরাও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাদক বেচাকেনা ও ব্যবহার রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। শিক্ষার্থী হতে শুরু করে সব বয়সীদের মধ্যেই মাদকাসক্ত রয়েছে। তারা মাদক ব্যবহার, বেচাকেনা ও পাচারের সঙ্গেও জড়িত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের একটা বিশাল অংশ এই সর্বনাশা মাদকে আসক্ত হবে। তাদেরকে চিকিৎসা দিয়েও সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে না- এমন সতর্কবাণী তারা দিয়েছেন।
এমিরেটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মাদক গ্রহণকারী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে স্ট্রোক, কিডনি, লিভার, নিউরোলজিসহ জটিল রোগে আক্রান্তের হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্ত তরুণ চিকিত্সা নিতে আসছে।
তাদের রোগের উপসর্গ সম্পর্কে চিকিৎসকরা জিজ্ঞাসা করলে তারা কেউ কোকেন, হিরোইন, ইয়াবা, গাজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবনের কথা জানায়। তারা জানায়, এই মাদক সেবন না করলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকছে পারছে না। কেউ কেউ বলে, তাদের হাত পা বাঁকা হয়ে আসে, মাথা ব্যথা করে ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
ওই সময় যেকোন ধরনের অপরাধ করতেও তাদের দ্বিধাবোধ করে না। এই স্বনামধন্য চিকিৎসকের মতে, এটা মাদকের কুফল। মাদক নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। সময় থাকতে মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে অভিমত দেন তিনি।
নিউরো সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, তরুণ ও শিক্ষিত সমাজকে ধ্বংস করার মারণাস্ত্র হল মাদক। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে বড় অংশ হল মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণী। প্রতিদিন এই ধরনের রোগে আক্রান্ত তরুণ তরুণীদের অবস্থা দেখে আমি রীতিমত আঁতকে উঠি। ভাবি, এ কী দৃশ্য দেখছি আমি!
এদের রক্ষায় কেউ কি এগিয়ে আসবে না! আক্রান্তদের অধিকাংশই হাটতে পারে না- প্যারালাইজড। পরবর্তীতে এদের অধিকাংশকেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। বিশিষ্ট এই নিউরোলজিস্ট আগামীতে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করার জন্য এই সর্বনাশা মাদক থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষায় সকল শ্রেণীপেশার লোককে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এন হুদা বলেন, মাদকাসক্ত তরুণ তরুণীসহ সকল বয়সী লোকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এদের যৌন ক্ষমতা স্থায়ীভাবে লোপ পাচ্ছে, চিকিত্সা দিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না। মাদকাসক্তদের মধ্যে মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, সরকারের প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা, কর্মচারীও রয়েছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, রাজনীতি নিয়ে বিরোধ থাকলেও মাদক ব্যবসা নিয়ে কারও মধ্যে কোন বিরোধ নেই। টেকনাফসহ সীমান্ত দিয়ে নৌপথ ও বিমানপথে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ কোকেন, হিরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক দেশে ঢুকছে। উদ্ধার হয় সামান্যই। এই মাদক পাচারের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য, বিমানবন্দরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তারা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। বিদেশেও তাদের বাড়ি-গাড়ি রয়েছে, এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, আমরা মাদক প্রতিরোধে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। এছাড়া আমাদের টাস্ক ফোর্সও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ