ভুক্তভোগী একজন গৃহিণী। বনানী থানাধীন মহাখালী আমতলী মোড় থেকে জিরাবো যাওয়ার পথে বাসে তার এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাকে অজ্ঞাত ব্যক্তি উপহার হিসেবে একটি কলম দেন। সেই কলম হাতে নেয়ার পর তার চিন্তা শক্তি কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি বাদীর মোবাইল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে নামিয়ে দেয়।
কয়েক ঘণ্টা পর ওই মহিলার চিন্তা শক্তি স্বাভাবিক হলে নিজেকে পল্লবী এলাকায় শনাক্ত করেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটি খুঁজে না পেয়ে একজন পথচারীর মাধ্যমে তার ছেলেকে মোবাইলে তার অবস্থান জানালে তার ছেলে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়।
বাসায় যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি তার ছেলের মোবাইল নাম্বারে ফোন করে তার মাকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাকে ছাড়ানোর জন্য ১ লাখ টাকা দিতে হবে অন্যথায় গুরুতর মামলায় চালান করে দিবে। পরে ফোন করা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দেয়া বিকাশ নম্বরে ৫৩ হাজার ৯৫৫ টাকা তার ছেলে পাঠায়। অজ্ঞাতনামা বিবাদীরা টাকার জন্য আরও চাপ দিলে বাদীর ছেলের কাছে আর টাকা না থাকায় দিতে অস্বীকৃতি জানান।
অজ্ঞাতনামা বিবাদীরা সর্বশেষ কোরআন শরীফ দানের হাদিয়া বাবদ ৬ হাজার ৫০০ টাকা চাইলে বাদীর ছেলে তাও দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ওই মহিলা সুস্থ হয়ে ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের বনানী থানায় মামলা করেন।
বনানী থানা মামলার তদন্ত শুরু করার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শফিকুল ইসলাম বাসে একা একা চলাচলরত মহিলা যাত্রীদের টার্গেট করে পাশের সিটে বসে কৌশলে বিভিন্ন আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়ে একটি বিশেষ কলম উপহার দেয়।
ওই কলমে গ্রেপ্তারকৃত আসামি শফিকুল ইসলাম একটি বিশেষ চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে রাখে এবং কলমটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে কলমে লেগে থাকা বিশেষ নেশা দ্রব্যের প্রভাবে ভিকটিমের চিন্তা শক্তি লোপ পায় এবং প্রতারকদের কথা মতো কাজ করতে থাকে ভুক্তভোগীরা।
সেই সুযোগে প্রতারক শফিকুল ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল এবং মূল্যবান সম্পদ (টাকা, পয়সা, গহনা) ইত্যাদি চেয়ে নেয়। পরে ভুক্তভোগীদের কৌশলে বাস থেকে নামিয়ে প্রতারকদের অন্য সঙ্গীদের নিকট নিয়ে যায়। ভিকটিমের মোবাইল থেকে আত্মীয়স্বজনের নাম্বার সংগ্রহ করে বিভিন্ন থানায় ওসি তদন্ত বা অপারেশন, কখনো ডিবি পরিচয়ে ফোন করে এবং ভিকটিমকে মাদক ও জাল টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে মর্মে জানায়।
ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজনদের তারা আরও জানায় যে, কিছু টাকা পয়সা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে; অন্যথায় গুরুতর মামলায় কোর্টে চালান করা হবে। তখন ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজন হতভম্ব হয়ে প্রতারকদের দেয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠায়।
একই কিসিমের ঘটনা ঘটেছে বারডেম হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বাবার সঙ্গেও। ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার বাবা রোজার শুরুর দিকে কয়েকদিন হাঁটতে বের হয়েছিলেন। একদিন বাসার কিছুদূর যাওয়ার পর এক সিএনজি চালক তার বাবাকে দেখে থেমে যায়। ভেতরে দু’জন প্যাসেঞ্জার রেখে সিএনজি চালক তার বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তখন ওমানের একটা টাকা হাতে দিয়ে টাকাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায় সিএনজি চালক। কথোপকথনের কিছু পরেই তার বাবা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান এবং প্রতারকদের ফাঁদে পা দেন। ওই সিএনজি দিয়ে তাকে নিয়ে প্রতারকরা এটিএম বুথে যায়। এক বুথে টাকা না পেয়ে আরেক বুথে যায়। সেখানেও না পেয়ে ব্যাংকে যায়। এভাবেই প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা সময় কেটে যায়।
চিকিৎসক জানান, বাবার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ থাকায় টাকা তুলে নিতে ব্যর্থ হয় প্রতারকরা। কিন্তু বাবা তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে এতটাই উদগ্রীব ছিলেন অফিস থেকে টাকা তুলে দিতে গিয়েছিলেন। অবশেষে সহকর্মীদের জেরার মুখে বাবা ঘটনাটি বললে তারা বাবাকে থামিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে বলেন যে আপনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। পরে বাবা দ্রুত স্বাভাবিক চিন্তাই ফিরে আসেন এবং বুঝতে পারেন যে তিনি মস্ত বড় একটি ভুল করতে যাচ্ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ডেভিল্স ব্রেথ বা শয়তানের শ্বাস বা মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় ছিনতাইকারী চক্র। অনেকটা অজ্ঞান বা মলমপার্টির আদলেই চক্রটি কাজ করছে। বলা হচ্ছে এটি ছিনতাইয়ের নতুন কৌশল। তবে অন্য ছিনতাইয়ের চেয়ে নতুন এই কৌশলটি একটু ভিন্ন। অন্যান্য ছিনতাইয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে জোরপূর্বক বা কিছু খাইয়ে অথবা কিছু নাকে লাগিয়ে অচেতন করে টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া হয় মূল্যবান সবকিছু।
কিন্তু শয়তানের শ্বাস দিয়ে ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় প্রতারক চক্রটি। বিশেষ ধরনের এই ড্রাগ যখন প্রতারকরা ভুক্তভোগীর সংস্পর্শে নিয়ে আসে তখন কিছু সময়ের জন্য ভুক্তভোগী স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না। প্রতারকরা তাকে যা বলেন তিনি তাই করেন। আর এই সুযোগেই তারা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই ড্রাগটি লিক্যুইড ও পাউডার জাতীয় হয়। খাবারের মাধ্যমে অথবা শ্বাসের মাধ্যমে কিংবা হ্যান্ডশেকের সময় ব্যবহার করা হয়। মূলত এটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চির দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ১ ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে খুব কম ভুক্তভোগী এসব ঘটনায় মামলা করেন। যে কয়টি মামলা হচ্ছে সেগুলোর তদন্ত করে আমরা আসামি গ্রেপ্তার করছি। তবে বাইরে একা চলাফেলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষ করে রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে অপরিচিত লোকের কাছ থেকে কোনো উপহার সামগ্রী গ্রহণ, অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতা ও কোনো খাদ্য গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। আর কেউ যদি এ ধরনের ঘটনার শিকার হন তবে অবশ্যই পুলিশকে জানাতে হবে।
এই ড্রাগের সম্পর্কে যা কিছু
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় গাছপালার ঝোপে জন্মাতে দেখা যায় বোরাচেরো নামের এক ধরনের ফুল। বোরাচেরো শত শত বছর ধরে স্থানীয় দক্ষিণ আমেরিকানরা আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে আসছে।
এটির বীজ যখন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গুঁড়া এবং নিষ্কাশন করা হয়, তখন বুরানডাঙ্গা নামক স্কোপোলামিনের মতো একটি রাসায়নিকের অস্তিত্ব মেলে এতে। যৌগটি হ্যালুসিনেশন, ভীতিকর চিত্র এবং স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিচালিত করে। এটি স্মৃতিভ্রংশ ঘটাতে পারে, যা শিকারকে ঘটনাগুলি স্মরণ করতে বা অপরাধীদের শনাক্ত করতে বাধা দেয়।
১৮৮০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট ল্যাডেনবার্গ প্রথম স্কোপোলামাইন আলাদা করেন বোরাচেরো উদ্ভিদ থেকে। এরপর থেকে এটি ট্রুথ সিরাম হিসেবে তদন্তের কাজে ব্যবহার করা শুরু করে ডাক্তার ও সরকারি সংস্থাগুলো।
১৯১০ সালে আমেরিকান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ হাউলে হার্ভে ক্রিপনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তার স্ত্রীকে উচ্চ মাত্রার স্কোপোলামাইন দিয়ে হত্যা করেছিলেন। এটির মাধ্যমে যে মৃত্যুও হতে পারে সেবারই প্রথম জানা গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর তথ্যমতে, এই “ট্রুথ সিরাম” প্রথম ১৯২২ সালে লস এঞ্জেলেস টেক্সাসের একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডক্টর রবার্ট হাউসের অনুসন্ধানে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। যিনি বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য স্কোপোলামাইন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। হাউসের প্রাথমিক পরীক্ষাগুলি অভিযুক্ত বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য আহরণে সফল প্রমাণিত হওয়ার পরে, তিনি এই বিষয়ে দশটিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং একটি আধা-জাদুকরী ট্রুথ সিরামের ধারণা জনসাধারণের চেতনায় প্রবেশ করতে শুরু করে।
সিআইএ বলছে, হাউসের গবেষণার পরে কিছু পুলিশ বাহিনী ব্যাপকভাবে এটি ব্যবহার করতে পারে বলে ধারণা ছিল তাদের। হাউস তার গবেষণায় দেখেছেন, কেউ স্কোপোলামাইন ব্যবহার করে “মিথ্যা তৈরি করতে পারে না”। তবে তার “চিন্তা বা যুক্তি দেওয়ার ক্ষমতাও থাকে না।” বন্দীদের কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য বের করার জন্য ড্রাগটির ক্ষমতা সন্দেহজনক প্রমাণিত হয়েছে। সিআইএ এবং সোভিয়েতরা তাদের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধে স্কোপোলামাইনের ব্যবহার করেছিল বলে মনে করা হয়। তবে এটির অসাধু ব্যবহার তখনও বিস্তৃত হয় নি।
১৯৯৫ সালের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নিবন্ধ অনুসারে, কলম্বিয়ার বোগোটার হাসপাতালগুলোয় সে সময় সব জরুরি কক্ষেই ভর্তির প্রায় অর্ধেক রোগীই ছিল বুরানডাঙ্গা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। অন্য এক গবেষণা বলছে, এই হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল না। স্কোপোলামাইন জিমসন উইড নামে আরেক উদ্ভিদেও পাওয়া যায়। এটির দেখা মেলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশে বিভিন্ন দেশে।
এই ওষুধ ডাক্তাররা তাদের প্রেসক্রিপশন ফর্মেও লিখে থাকেন। আপনি যদি সামুদ্রিক অসুস্থতায় ভুগে থাকেন, তাহলে হয়ত আপনি আপনার শেষ সমুদ্র অভিযানে স্কোপোলামাইন ব্যবহার করেছেন। সক্রিয় উপাদানটি ১ মিলিগ্রাম ট্রান্সডার্মাল প্যাচের মধ্যে পাওয়া যায় যা বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া বন্ধ করতে সহায়তা করে। প্যাচটিতে পাওয়া একটি বিশেষ হার-নিয়ন্ত্রক ঝিল্লি থেকে ওষুধটি ধীরে ধীরে ত্বকের মাধ্যমে শোষণ করে।
কম ডোজ এবং ধীর শোষণ বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। নিয়ন্ত্রিত উপায়ে হোক কিংবা না হোক, এটি সত্য যে এই ওষুধটির অপব্যবহারের খবর মিলছে বহু আগে থেকেই। উচ্চ মাত্রায় স্বাদ ও গন্ধহীন এই ড্রাগ ব্যবহার করলে শারীরিক নানান সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ