নারী আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও লিঙ্গ সমতার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদেন উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যে গতিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ দূরিভূত হয়ে পুরোপুরি লিঙ্গ সমতার জন্য মানব সভ্যতাকে আরও প্রায় ৩০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
বুধবার জাতিসংঘের নারী অধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউএন ওম্যান প্রকাশ করেছে প্রতিবেদনটি। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান অগ্রগতির যে হার, তা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের সব দেশ থেকে নারীর ওপর পুরুষের মালিকানা ও বৈষম্য বিষয়ক যাবতীয় আইনের বিলোপ ঘটতে সময় নেবে অন্তত ২৮৬ বছর, ১৪০ বছর লাগবে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমমর্যাদা, বেতন, ক্ষমতা ও নেতৃত্বে আসতে এবং রাজনীতি ও পার্লামেন্টে পুরুষ জনপ্রতিনিধিদের সমকক্ষ হতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও ৪০ বছর।’
জাতিসংঘের দৃষ্টি অবশ্য এই চিত্র বেশ হতাশাজনক। কারণ চলতি শতকের গোড়ার দিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য সম্পূর্ণ দূর করার লক্ষ্য নিয়েছিল জাতিসংঘ। ইউএন ওম্যানের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও চলমান বিভিন্ন ইস্যু বারবার সেই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
‘বৈশ্বিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, যেমন কোভিড মহামারি ও তার পরবর্তী অবস্থা, হিংসাত্মক সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও এ বিষয়ক বিভিন্ন অধিকারের চরম অবমনানা দিন দিন লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।’
বর্তমানে নারী ও পুরুষ্যের মধ্যকার বৈষম্যের চিত্র আরও স্পষ্ট করতে একটি পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষ দিকে বিশ্বজুড়ে চরম দারিদ্রের শিকার হতে যাচ্ছেন ৩৮ কোটি ৩০ লাখ নারী, যাদের দৈনিক উপার্জন হবে ১ দশমিক ৯ ডলারের চেয়েও কম। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৩৬ কোটি ৮০ লাখ।
এছাড়া ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছেন ৪ কোটি ৪০ লাখ নারী ও মেয়ে এবং ১২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
উপার্জন, নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই নারীদের পিছিয়ে থাকা বৈশ্বিক প্রথায় পরিণত হচ্ছে।’
ইউএন ওম্যানের নির্বাহী পরিচালক সিমা বাহাউস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে— উপার্জন, নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই নারীদের পিছিয়ে থাকা বৈশ্বিক প্রথায় পরিণত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রথাকে দ্রুত পাল্টানো প্রয়োজন। এবং পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে যত বেশি সময় ব্যয় হবে, ততই বাড়তি মূল্য দিতে হবে আমাদের।’
জলবায়ু সংকট এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের প্রেক্ষিতে লিঙ্গ সমতার অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থায়িত্বের সমস্যাগুলো আমাদের পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ওপর গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, তা অব্যাহত থাকবে। যারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রান্তিক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তারা এগুলোকে গভীরভাবে এর প্রভাব অনুভব করেন। নারী ক্রমবর্ধমানভাবে পুরুষের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর (নারী) অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য; কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনও নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার।
তারা বলেন, সমাজ বা রাষ্ট্র এই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেন বেরিয়ে আসতে পারছে না, সেটা জানাও খুব প্রয়োজন। তবে সমাজ ও পরিবারের কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পেলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। অনেক কর্মজীবী নারীই আছেন যারা নিজের কিংবা স্বামীর পরিবার থেকে কোনোরকম সহযোগিতা পান না। বরং কাজ করেন বলে নেতিবাচক কথা শোনেন। সেখানে একটু সহযোগিতা, পাশে থাকার আশ্বাস পেলেই নারী সুন্দরভাবে নিজের, পরিবার আর কাজকে সামলে চলতে পারেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৭
আপনার মতামত জানানঃ