জন্মলগ্ন থেকে সমাজ সভ্যতার চাকা পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নারীরাও ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আপন মহিমায়। শিক্ষা, কৃষি বা অর্থনীতি সর্বত্র নারীর পদচারণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজও নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও লিঙ্গ সমতার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান। অথচ দেশ কিংবা সমাজের উন্নয়ন নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অবদান ও অংশগ্রহণের ওপর।
অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর (নারী) অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য; কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনও নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার।
শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা একটি আলোচিত বিষয়। যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, পুরোনো ধ্যানধারণা আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু আবহমানকালের প্রথাগত সামাজিক চিত্রটি একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হতে এখনো যে অনেক বাকি তা স্পষ্ট হলো ২০২২ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে৷ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মজুরিতে নারী এখনো পুরুষের চেয়ে এত পিছিয়ে যে সমান হতে ১৩২ বছর লাগবে৷
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ)-এর বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী, মজুরিতে ইউরোপের নারীরাও পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে৷ এখনো তারা পুরুষদের চেয়ে গড়ে ১৩ শতাংশ বেতন কম পান৷
প্রতিবেদন বলছে, এই ব্যবধান ঘুচিয়ে পুরুষদের সমান বেতনের অধিকার অর্জন করতে ইউরোপের নারীদের আরো ৬০ বছর লাগবে৷
বেতন বা মজুরি এখনো কম পাওয়ার প্রধান কারণ দুটি৷ এক, নারীদের ঘরে এমন অনেক কাজই করতে হয়, যার জন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক পান না৷ এ কারণে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ছাড় দিতে হয় তাদের৷ এমন চাকরি করতে হয় যাতে পুরো আট ঘণ্টা কাজ না করলেও চলে৷
এছাড়া নির্মাণকাজ এবং মাইনিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মেয়েদের সুযোগ কম দেয়াও তাদের মজুরি কম হওয়ার অন্যতম কারণ৷ বিমা এবং আর্থিক খাতেও মেয়েদের চেয়ে পুরুষদেরই অনেক বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷
ফলে অপেক্ষাকৃত কম বেতনের চাকরিতে যোগ দিতে হয় নারীদের৷ এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী অনেক বেশি সময় কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু বেতন পান কম৷
নির্বাহী পদেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের সুযোগ অনেক কম৷ এমন পদে শতকরা ৯২ ভাগই এখনো পুরুষ, বাকি মাত্র আট ভাগ নারী৷
পাশাপাশি নারী নির্যাতনও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ঐতিহাসিক ধারায় দেখা যায়, সংবিধানের নীতি নারী পুরুষ, ধর্ম, সম্প্রদায়, শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষের সম-অধিকারের রক্ষাকবচ। অথচ আমরা পদে পদে দেখি প্রেম নিবেদনে সাড়া না দিলে অ্যাসিড ছোড়া, ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদা না দিলে ঘরের মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাওয়া নানারকম নির্যাতন।
অনেক নারী মেধাবী এবং রীতিমতো লড়াই করেই সমাজে নিজের অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে সমাজের সব নারীর জন্যই এমন সুযোগ কেন আসে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সরলীকরণ কঠিন। বলা যায় সমাজে বিদ্যমান নারীর প্রতি নানা ধরনের বৈষম্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি এর পেছনে কাজ করে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে সমাজ, মানুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি যেন অদৃশ্য এক কাচের দেয়ালকে প্রতীয়মান করে।
বাস্তবে, এই শব্দটা আক্ষরিক অর্থেই নারীর জন্য সমাজের বিশাল এক বাধাকে তুলে ধরে। অনেক গবেষণাতেও দেখা যায়, নারীরা পুরুষের মতো সমান মনোযোগী কাজ করার ক্ষেত্রে কাজে অবহেলা না করে অর্থপূর্ণভাবে সময় ব্যয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেন মেধা, পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টা থাকার পরেও নারীকে এই পরিণতিতে পড়তে হয়? এই বিষয়টা অনুধাবন করা সবার জন্যই জরুরি।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০৫
আপনার মতামত জানানঃ