নারী নির্যাতনে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নারীরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
বাংলাদেশে নারীদের যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাদের অধিকাংশেরই ঘাতক তাদের স্বামী। এমকি নিজেদের বাবা-মার বাড়িতেও হত্যার শিকার হন তারা। আর শ্বশুর বাড়ি তো আছেই।
স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এরমধ্যে কোনোটি বেশ আলোচনায় আসে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়৷ কিন্তু অনেক ঘটনাই থাকে আড়ালে। আর যেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় তার শেষ খবর আমরা রাখি না বা জানি না।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৩১৯ জন নারীর জীবনে এই চরম ঘটনা ঘটেছে; অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫০ জনের বেশি নারী হারিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে আত্মহত্যার চেয়ে হত্যার সংখ্যাই বেশি।
সংস্থাটি বলছে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে মোট ৩ হাজার ৩৭৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। বছর অনুযায়ী আলাদা করে বললে, ২০১৭ সালে ৫৯৭ জন, ২০১৮ সালে ৫২৮, ২০১৯ সালে ৫৮৭, ২০২০ সালে ৬৬১, ২০২১ সালে ৬৮৪ জন।
৯টি জাতীয় দৈনিক, কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আসক। যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন—মোটাদাগে এ ধরনের নির্যাতনের পর কত নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং কত নারী আত্মহত্যা করেছেন, তার পরিসংখ্যান রাখছে আসক।
পরিসংখ্যান বলছে, স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে খুনের ঘটনাও কম নয়।
চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৩১৯ জন নারীর জীবনে এই চরম ঘটনা ঘটেছে; অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫০ জনের বেশি নারী হারিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে আত্মহত্যার চেয়ে হত্যার সংখ্যাই বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি।
২০২০ সালে করা বিবিএসের অন্য আরেকটি জরিপ বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেড়েছে।
নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর সংখ্যা ও গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমনি হত্যাও বেড়েছে। বেড়েছে নারীর আত্মহত্যার হারও। সরকারকে দ্রুত এ বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে।
একদিকে মামলা যেমন কম হয় অন্যদিকে মামলা হলেও বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে৷ এর প্রধান কারণ সাক্ষী প্রমাণের অভাব এবং বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা। নারী নিজের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি যেখানেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন না কেন সেখানে সাক্ষী পাওয়া কঠিন। পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত সেই সাক্ষীদের অনেকেই আদালতে যান না।
আর হত্যাকাণ্ডকে অনেক সময়ই আত্মহত্যা বলে চালানো হয়৷ ফলে মামলা করাই কঠিন৷ থানা মামলা নেয় না। এরপর আদালতে যেতে হয়। তারপর থাকে ময়নাতদন্ত , ভিসেরা প্রতিবেদন, তদন্ত। আর এগুলো অনেক জটিল ও ঝামেলার বিষয়৷ স্ত্রী যখন হত্যার শিকার হন তখন মামলায় প্রধানত বাদী হন স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা৷ তাদেরও অনেকে শেষ পর্যন্ত মামলাটি চালিয়ে নেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর সন্তান থাকলে সেখানে “সন্তানের ভবিষ্যত’ চিন্তা করে সমঝোতা করা হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের একপর্যায়ে নারীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, নয়তো নারী মরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু স্বামী, স্বামীর পরিবারের সদস্য নন, সম্মান রক্ষার কথা বলে নিজ পরিবারের সদস্যরাও নারীকে মেরে ফেলছেন। যেকোনো পারিবারিক দ্বন্দ্বেও মূল টার্গেট হন পরিবারের নারী সদস্যটি। এটি সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের চিত্র হতে পারে না।
আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, আসক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান রাখছে। এর বাইরেও তো আরও ঘটনা ঘটছে। এই যে হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, এর পেছনের মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নারীর প্রতি সহিংসতার মামলাগুলো বিশেষ মামলা হিসেবে নজর পাচ্ছে না। নিম্ন আদালত পার হয়ে উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়েছে, এমন নজির না থাকায় অপরাধীরাও অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪০
আপনার মতামত জানানঃ