কঙ্গোর গোমা শহরের ঝলসানো রোদ আর ধুলায় মোড়া বাতাসের ভেতর একটি শিশু তার লোহার পাতের ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকে। বাইরের পৃথিবী তার জন্য নয়, কারণ সেই বাইরের জগৎ তাকে কষ্ট দেয়, প্রশ্ন করে, হেয় করে। তার কোঁকড়ানো চুল আর হালকা রঙের ত্বক তাকে আলাদা করে দেয়, যেন সে অন্যরকম কেউ—একটি শিশুর কাছে যে সত্যটি বোঝা সম্ভব নয়, অথচ প্রতিনিয়ত সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তার নাম দিমিত্রি—নামটি বদলে দেওয়া হয়েছে, তবে বাস্তবতা বদলায়নি। সে এমন এক সম্পর্কের প্রতিফলন, যা শুরু হয়েছিল ভালোবাসার মতো করে, কিন্তু শেষ হয়েছিল নিশ্চুপ এক অদৃশ্যতায়।
দিমিত্রির মা কামাতে বলেন, ইউরি নামের এক শান্তিরক্ষীর সঙ্গে তার তিন মাসের সম্পর্ক ছিল। ইউরি রাশিয়ান, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য, যার আচরণে কামাতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে এ মানুষটি বাকি পুরুষদের মতো নয়। কিন্তু এই সম্পর্কের মধ্যেও যে এক ভয়াবহ ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ছিল, তা বুঝতে তার সময় লেগেছে। গর্ভধারণের খবর শুনে ইউরি যখন তার যত্নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তখন কামাতে ভেবেছিলেন এটি এক নতুন জীবনের সূচনা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠেছিল এক মর্মান্তিক পরিত্যাগের গল্প। ইউরি কোনো কথা না বলেই হারিয়ে যায়—ফোন নম্বর বন্ধ, পরিচয়ের কোনো চিহ্ন রেখে যায় না। কামাতে আজও একটি পুরনো সামরিক টুপি আর একটি ছবি আগলে রেখেছেন, যে স্মৃতির জঠরে জন্ম নিয়েছে দিমিত্রির মতো শিশু।
এই গল্প কেবল একটি ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যের নয়, বরং একটি বড় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন এমওএনইউএসসিও ১৯৯৯ সাল থেকে সক্রিয়, কিন্তু সেই সময় থেকেই মিশনটি নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন শোষণ এবং নির্যাতনের অভিযোগে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইউনাইটেড নেশনস সাধারণ পরিষদ ২০০৫ সালে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, শান্তিরক্ষী ও স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক—even সম্মতিক্রমে হলেও—ক্ষমতার অসাম্যতার কারণে শোষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। অথচ বাস্তবে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে যেখানে মেয়েরা গর্ভবতী হয়েছে, সন্তানের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু বাবার পরিচয় পর্যন্ত তারা জানে না।
মারিয়া মাসিকার গল্প যেন এই সংকটকে আরও গভীরভাবে তুলে ধরে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান শান্তিরক্ষীর প্রেমে পড়েন। সেই শান্তিরক্ষী ঘাঁটির কাছে একটি বাড়ি ভাড়া করে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। যখন মেয়ে কুইনের জন্ম হয়, তখন সেই শান্তিরক্ষী নিরুদ্দেশ। মাসিকা এখন গোমা শহরে যৌনকর্মী হিসেবে জীবনধারণ করছেন—একটি সমাজ যেখানে নারীকে একা মা হওয়ার দায়ে নিন্দিত হতে হয়, অথচ দায়ী ব্যক্তি নিরাপদে দূরে থেকে যায়।
এইসব ঘটনায় সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিক হলো—জাতিসংঘের সরাসরি বিচারিক ক্ষমতা নেই। শান্তিরক্ষীরা যখন শোষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়, কিন্তু সেখানে অধিকাংশ সময় কোনো বিচারই হয় না। অনেক সদস্য রাষ্ট্র অভিযোগ তদন্তে আগ্রহী নয়, কিংবা এমনভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দেয় যেন কিছুই ঘটেনি। ফলে অভিযুক্তরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, নতুন জায়গায় আবার একই অপরাধে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কঙ্গোর মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে, যেখানে দরিদ্রতা, বাস্তুচ্যুতি ও নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপক, সেখানকার নারীরা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকে। তাদের সেই দুর্বলতা কাজে লাগিয়েই শান্তিরক্ষীর মতো কর্তৃত্ববান ব্যক্তিরা যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে—যা পরিণত হয় চূড়ান্ত শোষণে।
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে শান্তিরক্ষা এবং রাজনৈতিক মিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট যৌন নির্যাতন ও শোষণের অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১০০, যা ২০২২ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এর মধ্যে কেবল কঙ্গোতেই ৬৬টি অভিযোগ এসেছে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২৮ জন ছিল শিশু, যাদের অধিকাংশের পরিচয় বা জবাবদিহির কোন প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি।
কঙ্গোতে এমন অনেক শিশু রয়েছে যারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের সন্তান, কিন্তু যাদের সমাজে জায়গা নেই, পরিবারে স্বীকৃতি নেই। গোমার একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ‘কঙ্গোলিজ ফ্যামিলি ফর জয়’-এ এমন পাঁচটি শিশু রয়েছে, যাদের মায়েরা তাদের ত্যাগ করেছে সমাজের অপবাদ আর দারিদ্রের চাপে। এ কেন্দ্রের পরিচালক জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন নারীকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে যারা শান্তিরক্ষীদের দ্বারা শোষিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই আজও সমাজের নিন্দা আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে ক্লান্ত।
জাতিসংঘ বলছে, তারা “জিরো টলারেন্স” নীতিতে বিশ্বাস করে। অভিযোগ পেলে তদন্ত হয়, দোষী প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, এসব পদক্ষেপ অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, ভুক্তভোগীদের কাছে এসব পৌঁছায় না। কামাতে কিংবা মাসিকার মতো নারীরা জাতিসংঘের সহায়তার অস্তিত্ব পর্যন্ত জানতেন না। অনেকে তো এতটাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন যে, কোনো অভিযোগ করার শক্তিও আর থাকে না।
এই চিত্র শুধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী ব্যবস্থার এক গভীর ফাঁকফোকরের প্রতিচ্ছবি। যখন যিনি রক্ষা করার কথা, তিনিই শিকার বানিয়ে চলে যান, তখন সেই বিশ্বাসের খণ্ডন ঘটে, যেটা জাতিসংঘের মতো সংস্থার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। যুদ্ধের মাঝখানে শান্তির পোশাকে লুকিয়ে থাকা এই যৌন সহিংসতা যেন এক নীরব গণহত্যা—যেখানে নিহত হয় বিশ্বাস, আত্মমর্যাদা, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
এখন সময় এসেছে, জাতিসংঘ কেবল নীতিগতভাবে নয়, বাস্তবিক অর্থেই দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক চাপ, বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য সক্রিয় সহায়তা ছাড়া এই ঘৃণ্য চক্র বন্ধ করা সম্ভব নয়। কঙ্গোতে যে শিশুরা আজ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে বেড়ে উঠছে, যারা জানেই না তাদের পিতৃপরিচয়, তাদের প্রতি জাতিসংঘের দায়িত্ব শুধুই অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, বরং একটি ন্যায্য উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা।
আপনার মতামত জানানঃ