আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত দুই মাসে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে তালিবান। ৮০ হাজার তালিবান জঙ্গির মোকাবিলায় নাস্তানাবুদ তিন লাখ সেনা ও পুলিশ। তালিবান বাহিনীর এমন সাফল্যের পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনার পাশাপাশি বিপুল অর্থশক্তি বড় কারণ বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
আফগানিস্তানে ১৫ বছর ধরে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের আফিম, হেরোইন ব্যবসা থেকে তালিবানের মুনাফা অর্জন বন্ধ করা। এই অভিযানে পপি চাষ নির্মূল থেকে শুরু করে সন্দেহভাজন ল্যাবে বিমান হামলাও চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এখনো গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালিবানরাই। আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীজুড়েই মাদক সমস্যা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
আফগনিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ। হেরোইন তৈরিতে এই আফিম প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ হেরোইন যায়, এর ৯৫ শতাংশই আফগানিস্তান থেকে যায়। ।
আফগানিস্তানে আফিমের চাষ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তারপরেও দরিদ্র কৃষকরা অর্থের জন্যে এই পপি চাষে উৎসাহিত হন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। পপি চাষ বন্ধ করার জন্য চাষীদের নানা ধরনের বিকল্প পণ্য যেমন আনার ও জাফরান চাষের জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার পরও এই অবস্থা।
পপি চাষে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র কান্দাহার প্রদেশ। হেলমান্দের পর এর অবস্থান। কান্দাহারের ২ একর জমিতে পপি বুনেছিলেন ৩৫ বছর বয়সী কৃষক মোহাম্মদ নাদির। রয়টার্সকে তিনি বলেন, গম বা অন্যান্য ফসল চাষ করলে তাদের যথেষ্ট লাভ হয় না। তার ক্ষেতে চাষ করা পপি থেকে আয় হবে ৩ হাজার ডলার। অথচ ওই একই জমিতে যদি তিনি গম চাষ করতেন তাহলে তার আয় হতো ১ হাজার ডলার কম। যদিও পপি চাষ করে পাওয়া টাকা তিনি একাই নিতে পারবেন না। জমি রক্ষা করার জন্য তালিবান ও মাদক বিক্রির জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদেরকে ভাগ দিতে হবে।
কাবুলের পতনের পর গোটা আফগান অর্থনীতিতে চরম মাত্রায় ধস নেমেছে। আসন্ন দিনগুলোয় দেশটিতে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। গৃহযুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অদূরভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়া এ আফগান নাগরিকদের দুরবস্থার সুযোগ নিতে পারে তালিবানরা। তাদের নিয়োজিত করা হতে পারে মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে।
এছাড়া আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে বৈদেশিক অনুদাননির্ভরতা অনেক বেশি। তালিবানদের কাবুল দখলের ধারাবাহিকতায় এ অনুদানের বড় একটি অংশ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তালিবানরা আয়ের জন্য নিশ্চিতভাবেই মাদক বাণিজ্যের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালিবানরাই। আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীজুড়েই মাদক সমস্যা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মানিকন্ট্রোলে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সাংবাদিক প্রবীণ স্বামী জানাচ্ছেন, মাদক ব্যবসা এখন আফগান অর্থনীতির প্রকৃত মেরুদণ্ড হয়ে উঠছে। ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তালিবানদের মোট আয়ের অর্ধেকই এসেছে মাদক ব্যবসা থেকে। এজন্য নারকোটিক ফসল উৎপাদন ও চাষাবাদ, এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং মধ্য এশিয়ার ভেতর দিয়ে অপরাধীনির্ভর সরবরাহ রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে তাদের। এখন তাদের হাতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের এ প্রকৃত সুযোগকে কাজে লাগাবে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিনদের এসব উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। আফিম চাষের ওপর নির্ভরশীল আফগান কৃষকদের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছে কাবুলের সরকার ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকরা। এ আফিমচাষী কৃষকরা শেষ পর্যন্ত তালিবানদেরই অনুগত হয়ে উঠেছেন।
অতীতে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও আফগানিস্তানের আফিম চাষ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন তালিবান সরকার আফিম চাষ বন্ধের ঘোষণা দেয়। পুরোপুরি বন্ধ না করলেও ওই সময় পপি চাষ কমিয়ে আনে তালিবানরা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আফিমচাষীদের বড় একটি অংশ তালিবানদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের তালিবানবিরোধী অভিযান শুরু হলে সে সময় তারা তালিবানদের পক্ষ ত্যাগ করে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানের পথে থাকলেও আফগানিস্তান এখনও বিশ্বের বৃহত্তম অবৈধ আফিম সরবরাহকারী। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া, বিদেশি সহযোগিতা হ্রাস, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশি সেনাদের স্থানীয় বাজারে ব্যয় কমে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের কারণে আফগানরা বেঁচে থাকার জন্য মাদক ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।
জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন, আফগানিস্তান বিশৃঙ্খলায় পতিত হলে অবৈধ আফিম উৎপাদন আরও বেড়ে যেতে পারে। যা তালিবানের জন্য সম্ভাব্য আশীর্বাদ হতে পারে।
কাবুলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংস্থার প্রধান সিজার গুডেস বলেন, তালিবানরা নিজেদের আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে আফিম ব্যবসাকে বিবেচনা করে। বেশি উৎপাদন হলে মাদকের মূল্য কম ও আকর্ষণীয় হবে। ফলে তা একেবারে সহজে পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘ সংস্থার মতে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে সর্বোচ্চ পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারিতেও গত বছর উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।
জাতিসংঘ ও ওয়াশিংটনের মতে, পপি চাষ থেকে শুরু করে, আফিম আহরণ, পাচার ও উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ‘কর’ সংগ্রহ করে তালিবান। মাদক ল্যাব থেকে পাচার থেকেও মুনাফা আসে গোষ্ঠীটির। আফ্রিকা, ইউরোপ, কানাডা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক পাচার থেকে ফি আদায় করে তালিবানরা।
আফগানিস্তানে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করা ডেভিড ম্যান্সফিল্ডের মতে, এসব মাদকের কিছু চালান কঠোর নিরাপত্তা থাকা সীমান্ত দিয়ে ইরানের পাচারকারীদের কাছে পাঠানো হয়।
জাতিসংঘ কর্মকর্তারা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মাদক ব্যবসা থেকে ৪০০ মিলিয়নের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে তালিবান।
মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদনে একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়েছে, তালিবানের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে অবৈধ মাদক থেকে।
ম্যান্সফিল্ডের মতে, অবৈধ আফিম থেকে তালিবানের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে। এই অর্থ আসে মূলত আফিম উৎপাদন, হেরোইন ল্যাব ও মাদক পাচারের চালান থেকে লেভি সংগ্রহের মাধ্যমে। কিন্তু বৈধ আমদানি ও রফতানি থেকে ফি নিয়ে মাদকের চেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করে তালিবান যোদ্ধারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ