আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করেছে তালিবান। তালিবানের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর একটি চিঠিতে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আফগানিস্তানে নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
উচ্চতর শিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিম ওই চিঠিতে সই করেছেন। ওই মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জিয়াউল্লাহ হাশিমি পরে টুইটে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জাতিসঙ্ঘ মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক এই পদক্ষেপকে ‘ঝামেলাপূর্ণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা তালিবানের আরেকটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ।’
ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও নতুন এ ঘোষণার নিন্দা জানিয়েছে। এ ঘোষণার পর জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রদূত রবার্ট উড বলেছেন, ‘তালিবানরা সব আফগানদের অধিকার, বিশেষ করে মানবাধিকার এবং নারী ও মেয়েদের মৌলিক স্বাধীনতাকে সম্মান না করা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে পারে না।’
জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেছেন, ‘এ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশটিতে নারীদের অধিকার আরও কমিয়ে দেওয়া হলো এবং প্রতিটি নারী শিক্ষার্থীর জন্য এটা গভীর হতাশার বিষয়।’
তবে তালিবান জানিয়েছে, ‘জাতীয় স্বার্থ’ এবং নারীদের ‘সম্মান’ রক্ষায় এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বিবিসিকে বলেছেন, খবরটি শোনার পর থেকে তিনি কেঁদেই চলছেন।
পদক্ষেপটির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় আফগান নারীদের প্রবেশাধিকারকে আরও সীমিত করল তালিবান। দেশটিতে ইতিমধ্যে বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে।
তিন মাস আগেই আফগানিস্তানজুড়ে হাজারো নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তখন নারী শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন বিষয়ের ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। বিশেষ করে পশুচিকিত্সা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, অর্থনীতি, সাংবাদিকতার মতো বিষয় নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল তালিবান।
গত বছর আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। ক্ষমতা দখলের পর আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য পৃথক শ্রেণিকক্ষ ও প্রবেশপথ চালু করেছিল তালিবান। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের শুধু নারী শিক্ষক বা বয়স্ক পুরুষ শিক্ষক পড়াতে পারতেন।
তালিবানের সবশেষ নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির এক নারী বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী বিবিসিকে বলেন, তিনি মনে করেন, তালিবান নারী ও নারীর শক্তিকে ভয় পায়।
ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমাকে আমার ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারত যে সেতুটি (শিক্ষা), সেটিই তারা (তালিবান) ধ্বংস করে দিয়েছে।’
ক্ষুব্ধ ছাত্রী বলেন, ‘আমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি? আমি বিশ্বাস করতাম যে পড়াশোনা করে আমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারব, আমার জীবনে আলো আনতে পারব। কিন্তু তারা (তালিবান) তা ধ্বংস করে দিয়েছে।’
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের শিক্ষা খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বছর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পর দেশটির প্রশিক্ষিত অনেক শিক্ষাবিদ দেশত্যাগ করেন।
১৯৯০-এর দশকে তালিবানের প্রথম শাসনমেয়াদে নারীদের জন্য কঠোর সব বিধিনিষেধ জারি ছিল। নারীদের কাছ থেকে প্রায় সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেদের পূর্ববর্তী কঠোর নীতি নমনীয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। তবে প্রতিশ্রুতি রাখেনি তালিবান। আফগানিস্তানের সামাজিক জীবন থেকে একপ্রকার অদৃশ্য হয়ে গেছে নারীরা।
আফগানিস্তানে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে গোঁড়ামি। ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মেয়াদে কাবুল দখলের পর পূর্বের মতো কট্টর না হবার আশ্বাস দিলেও, বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। আবার জেঁকে বসেছে কট্টর তালিবান রাজ। মেয়েদের পড়ালেখা থেকে নারীদের কর্মস্থল সবখানেই ফতোয়া-নিষেধাজ্ঞা। বাদ পড়েনি সরকারি চাকরিজীবী নারীরাও।
গত আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালিবান৷ এরপর থেকে সেখানকার নারীদের পোশাক, চলাফেরা ও শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা, যদিও শুরুতে বিপরীতই বলা হয়েছিল সংগঠনটির পক্ষ থেকে৷
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে তালিবানের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় আফগানিস্তানের কয়েকটি এলাকার নারীদের জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তালিবানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তালিবান বলছে, যেসব কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ আলাদা করে কাজ করার সুযোগ আছে, শুধু সেসব জায়গাতেই নারীরা কাজের সুযোগ পাবেন। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে কার্যত নারীরা চাকরিতে নিষিদ্ধ। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষার মতো খাতগুলো বাদ দিলে তাদের সরকারি চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে।
এর রেশ ধরেই, পুলিশ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন প্রায় চার হাজার নারী। গার্ডিয়ানে দেওয়া আফগান পুলিশের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গুলফারোজ ইবতেখারের এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তালিবানরা প্রায় ৪০০০ মহিলা পুলিশ সদস্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক সদস্যকে মহিলা কারাগার চালানোর জন্য রেখে বাকিদের চাকরিচ্যুত করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন নারীকল্যাণ সংস্থা বিলোপ করেছে তালিবান সরকার।
এমনকি বেসরকারি খাতে কর্মরত নারীরাও অফিসে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন। তালিবানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রায়ই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ আলাদাভাবে কাজ করার কঠোর রীতি মানা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
আফগানিস্তানে গত দুই দশকে পুলিশ থেকে আদালত পর্যন্ত সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছিল। তবে গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর লাখো আফগান নারী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
তালিবানের প্রথমবারের শাসনমেয়াদে নারীদের জন্য বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। এবার ক্ষমতা দখলের পর তালিবান জানায় নারীরা মাথায় হিজাব কিংবা স্কার্ফ পরলে চলবে।
তবে তালিবানের নীতিনৈতিকতা-বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাবুলের বিভিন্ন জায়গায় যে পোস্টার লাগিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, নারীদের অন্তত হিজাব বা স্কার্ফ পরতে হবে। তবে এর সঙ্গে যে ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তা বোরকার ছবি।
পুরুষ স্বজন ছাড়া নারীদের এক শহর থেকে অন্য শহরে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে তালিবান। নারীদের মাথায় স্কার্ফ না দেখলে তাদের ট্যাক্সিতে না তোলার জন্য চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তালিবান আগস্টে ক্ষমতা দখল করার আগে বিউটি পারলার ও বুটিক শপ দেখা যেত। সেগুলোর বেশির ভাগই এখন আর নেই। হেরাতে বিভিন্ন দোকানের ম্যানিকুয়িনের (দোকানে পোশাক সাজিয়ে রাখার পুতুল) মাথা ফেলে দেওয়া হয়েছে। যেসব বিলবোর্ডে মানুষের ছবি আছে, তা নামিয়ে ফেলা হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নারী শিল্পী অভিনীত নাটক দেখানো বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারী সাংবাদিকদেরও ক্যামেরার সামনে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ