ফেনীতে এক ব্যবসায়ীকে আটক করে তার কাছ থেকে ২০টি সোনার বার আত্মসাৎ করার অভিযোগে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ ছয় পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মডেল থানা পুলিশ। একই সঙ্গে আত্মসাৎকৃত ২০টি বারের মাঝে ১৫টি উদ্ধার করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফেনী জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম এবং তিন উপ-পরিদর্শক (এসআই), দুই সহকারী উপ-পরিদর্শকসহ (এএসআই) ছয় জনকে আটক করেছে জেলা পুলিশ।
আটক অন্যরা হচ্ছেন এসআই মোতাহের হোসেন, মিজানুর রহমান ও নুরুল হক এবং এএসআই অভিজিত বড়ুয়া ও মাসুদ রানা।
মঙ্গলবার (১০আগস্ট) তাদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ডাকাতি মামলা হয়েছে। জেলা পুলিশ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ১৫টি স্বর্ণের বার জব্দ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে ২০টি স্বর্ণের বার নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস। ফেনীর ফতেহপুর রেলক্রসিং এলাকায় পৌঁছালে ডিবি পুলিশের ওই সদস্যরা তার গাড়ি থামান। ওই সময় তার কাছে থাকা ২০টি স্বর্ণবার নিয়ে যান তারা।
পরে নানা চেষ্টা করেও গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যদের থেকে স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে এ বিষয়ে গোপাল জেলা পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
ব্যবসায়ীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্য থেকে ৬ জনকে শনাক্ত করে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ফেনী মডেল থানায় হস্তান্তর করেন। একই সঙ্গে অভিযুক্তদের কাছ থেকে আত্মসাৎকৃত ১৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেন।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ঘটনা তদন্তে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন মঙ্গলবার ফেনী আসেন। জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর রাতে ফেনী মডেল থানায় মামলা রেকর্ড হয়। ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসের দায়েরকৃত মামলায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো: সাইফুল ইসলাম ছাড়াও এসআই মোতাহার হোসেন, মিজানুর রহমান ও নুরুল হক এবং এএসআই অভিজিত বড়ুয়া ও মাসুদ রানাকে আসামি করা হয়।
পুলিশের ওই সূত্র আরো জানায়, তদন্তকালে ওসি সাইফুলের কাছ থেকে লুট হওয়া ১৫টি বার উদ্ধার করা হয়েছে।
ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) খোন্দকার নুরুন্নবী গণমাধ্যমকে জানান, রোববার (৮ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে যাওয়ার সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস ফেনী ফতেহপুর রেলক্রসিং এলাকায় পৌঁছালে ডিবি পুলিশের সদস্যরা তার থেকে স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে যায়। পরে গোপাল দাস ফেনীর এসপির কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করে। পরে এসপি তাদের শনাক্ত করে চার জনকে প্রাথমিকভাবে আটক করে।
পরবর্তীসময়ে তাদের জবানবন্দিতে আরও দু’জনকে আটক করা হয়। এসপি তাদের কাছ থেকে ১৫টি স্বর্ণের বার জব্দ করে। বাকি পাঁচটির ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করছে।
এসপি খোন্দকার নুরুন্নবী জানান, এ বিষয়ে ফেনী মডেল থানায় ডাকাতি মামলা দায়ের করেছেন ভূক্তভোগী ব্যবসায়ী। অভিযুক্ত ৬ পুলিশ সদস্যকে আগামীকাল (বুধবার) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হবে। বাকি ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘‘যত গবেষণা বা জরিপ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে পুলিশ সব সময় দুর্নীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে আছে৷ এছাড়া মানুষকে হয়রানি করে, পকেটে মাদক- অস্ত্র দিয়ে পুলিশ ঘুষ আদায় করে বলে অভিযোগ আছে।
তারা বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচারিক প্রক্রিয়া এই ধরণের প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তখন মানুষের বঞ্চনা বাড়ে এবং ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়ে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
তারা বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, আইনের রক্ষক হয়ে যখন একজন পুলিশ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, একজন অপরাধীর চেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে সম্পূর্ণই এর বিপরীত। অপরাধ জগতের ডন হয়েও শাস্তি পায় সাময়িক বরখাস্ত ও পুলিশ লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
তারা বলেন, আইনকে ব্যবহার করে তাদের চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্ম একদিকে যেমন পুলিশের জন্য লজ্জার অপরদিকে দেশের জন্যও। সাম্প্রতিককালে পুলিশের এহেন অপকর্মের অভিযোগ সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি পরিমাণে আসছে। পুলিশের কাছে অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, কর্মজীবীরা। কিছু হলেই সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভয়ানক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়। যখন তখন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লুটে যাচ্ছে প্রচুর টাকা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১১
আপনার মতামত জানানঃ