পঞ্চদশ ও ষষ্টদশ শতকে এক রহস্যময় মহামারি ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সূচনাটা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। তারপর উল্কাগতিতে ছড়িয়েছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশে। কী থেকে রোগ ছড়াচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এসেছিল শহরের অলিতে গলিতে; রাজপরিবারের অন্দরমহলে। সে এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই মহামারি মৃত্যুর পর মৃত্যু ঘটিয়ে চলেছিল ইউরোপে। জনশূন্য হয়ে পড়েছিল ইউরোপের গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ৫৩৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এই রোগের কারণ আজো জানতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।
আগ্রহীরা এই নিবন্ধটির অডিও শুনতে পারেন।
পৃথিবীতে যত মহামারী হানা দিয়েছে তার বেশিরভাগটাই কোনও না কোনও যুদ্ধ চলাকালীন বা যুদ্ধ পরবর্তী সময়েই হানা দিয়েছে। এই সোয়েটিং সিকনেস বা ঘাম রোগ যখন ছড়িয়েছিল তখন পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক। ১৪৮৫ সাল; বসওয়র্থ ফিল্ডের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৪৫৫ সালে শুরু হওয়া ‘ওয়ার অব রোজেস’-এর শেষ পর্যায় বসওয়র্থ ফিল্ড ওয়ার; প্রায় ৩০ বছর ধরে ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্কের মধ্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পরে ইংল্যান্ড প্রায় বিচ্ছিন্ন, তছনছ হয়ে পড়েছে। এই মহামারি যখন ছড়ায় তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মসনদে রাজা সপ্তম হেনরি রাজ করছেন।
১৪৮৫ সালের অগস্ট মাস; অজানা এই অসুখ ছড়াতে শুরু করে ব্রিটেনে। তবে অনেক পরে ১৫৫১ সালে শ্রিউসবারির চিকিৎসক জন কেইয়াস এই রোগকে প্রথম শণাক্ত করলেন। এর পূর্বে ১৪৮৫ সাল থেকে পাঁচবার এই রোগ মহামারি আকারে প্রকাশ পেয়েছিল। সোয়েটিং সিকনেসের অনুরূপ আরেকটি রোগ ১৭১৮ সাল থেকে ১৮৭৪ সালে উত্তর ফ্রান্সে ছড়িয়েছিল। রোগটির নাম ছিল পিকার্দি সোয়েট। সে সময় দুই শতাধিক ব্যক্তি অসুস্থ হয়েছিল।
সে সময় রাজা সপ্তম হেনরিকে এই রোগের বিশদ বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ডাক্তার থমাস ফ্রস্টিয়ার। তিনিও তখন সোয়েটিং সিকনেস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। রোগীদের পরীক্ষা করছেন। থমাস বললেন, বসন্তকাল আর গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণেই ছড়াচ্ছে এই রোগ। কী কারণে ঘাম হচ্ছে তা অবশ্য তিনি ধরতে পারেননি। তবে রোগের কিছু লক্ষণ বলেছিলেন। চিঠিতে থমাস লিখেছিলেন, ঘাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেছে রোগীর হার্ট ও ফুসফুসের চারপাশে বাষ্প জমছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রোগীর। তবে ত্বকে কোনও র্যাশ, ফোস্কা বা চুলকানি দেখা যাচ্ছে না কারও। শরীরের ভেতরটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আর তাতেই দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে রোগীর।
সপ্তম হেনরির সময়কালে এই রোগে এক মাসের ভেতরেই ১০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৫০৭ সালে আবারও কিছুটা দুর্বলভাবে এই রোগটি বিস্তার লাভ করেছিল। তবে এই দুর্বলভাবে বিস্তার হওয়া রোগটিই পরবর্তীকালে তৃতীয়বারের মতো মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। যা ফ্রান্স পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয়বার ছড়িয়ে পড়া রোগটি কিছু কিছু এলাকার অর্ধেকের বেশি লোককে মেরে ফেলেছিল। চতুর্থবার যখন এই রোগ প্রকাশ পায় তখন দ্রুত পুরো ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। জানা যায়, চতুর্থবার ইংল্যান্ড জুড়ে রোগটি বিস্তার লাভ করলে অষ্টম হেনরি ভয়ে লন্ডন থেকে পালিয়েছিলেন। রোগ থেকে বাঁচার আশায় নিয়মিত এক বাসভবন থেকে অন্য বাসভবনে চলে যেতেন। প্রতিরাতে ভিন্ন ভিন্ন বিছানায় ঘুমাতেন।
এরপর এই রোগ হঠাৎ হামবুর্গে ছড়ায়। সেখানে লন্ডনের মতোই কাজ করতে থাকে রোগটি। হামবুর্গেও দ্রুত ছড়ায় এবং মাত্র এক সপ্তাহের মাঝেই এক হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এই রোগ পুরো ইউরোপে ছড়িয়েছিল। পরে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড এবং রাশিয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তবে রোগটি ১৫৫১ সালের পর থেকে আর দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়
সোয়েটিং সিকনেস রোগটির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পদশালী ও উপরের শ্রেণির লোকদের আক্রমণ করত। তৎকালে ডিউক, বিশপ, মেয়ররা আক্রান্ত হয়েছিল। মঠগুলিতে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছিল। আর পাদরীবর্গের মৃত্যু হয়েছিল বেশি। এই রোগে রাজা সপ্তম হেনরির (হেনরি ৭) স্ত্রী অ্যানি বলেইনও আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থও হয়েছিলেন। তবে তাদের সন্তান আর্থার টিউডর মারা গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ইংল্যান্ডের সবকটি প্রাসাদে তখন হানা দিয়েছিল এই মারণ রোগ। রাজার মন্ত্রী থমাস ক্রমওয়েল তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে হারিয়েছিলেন।
এই রোগের সবচেয়ে মারাত্মক দিকটি ছিল দ্রুত মৃত্যু ঘটানোর বিষয়টা। অধিকাংশ রোগীই লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ১৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা যেত। এত দ্রুত মারা গেলেও রোগটির আরেকটি আশ্চর্যজনক রহস্য ছিল। তা হচ্ছে কোনো রোগী যদি ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকত তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতেন।
সেই মহামারি রোগে আক্রান্ত রোগী প্রথমে জ্বর এবং ঠান্ডা কাঁপুনি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেত। এছাড়াও এসবের পাশাপাশি মাথা ধরা, ঘাড়, কাঁধ এবং পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করত। এ সময় রোগী মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত। প্রথম ধাপে শুরু হওয়া ঠান্ডা কাঁপুনি অর্ধ ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত থাকত। এরপর দ্বিতীয় ধাপ শুরু হতো। দ্বিতীয় ধাপে গরম পর্ব শুরু হতো। অর্থাৎ রোগীর শরীর গরম হয়ে যেত। এ সময় ঘাম ঝরা শুরু হতো এবং পিপাসা লাগত। পাশাপাশি রোগী প্রলাপ বকত। নাড়ির স্পন্দন বেড়ে যেত, বুক ধড়ফড় করত এবং বুক ব্যথা করত। তৃতীয় ধাপ তথা চূড়ান্ত পর্বে রোগী অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এই ঘুম থেকে আর জেগে উঠত না।
ঘাম রোগের আসল কারণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। প্রায় ৫৩৬ বছর আগে যে রোগ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে তার কারণ হিসেবে অনেকরমক তথ্য উঠে এসেছে। গবেষকরা বলেছিলেন, হান্টাভাইরাস রোগের কারণ হতে পারে। ইঁদুর, বাদুড় জাতীয় প্রাণীর থেকে ছড়িয়েছিল অসুখ। যেসব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল সেগুলোর সঙ্গে হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিন্ড্রোমের বিস্তর মিল ছিল। মৃত্যুহার ছিল শতকরা ৩৬ ভাগ! তবে হান্টাভাইরাসই রোগের কারণ কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
বর্তমান সময়ে হান্টাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বিরল। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোরিয়ার যুদ্ধের সময় ‘কোরিয়ান হেমোরেজিক ফিভার’ সৈন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগের কারণ ছিল হান্টাভাইরাস। সে সময় প্রতি দশজন রোগীর মধ্যে একজন মারা যেত হান্টাভাইরাসের কারণে।
আবার অনেক গবেষক মনে করেন, ভাইরাসটি আর্থ্রোপোডা পর্বের পতঙ্গ যেমন– এঁটুল (Tick) এবং মশার মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। ধারণা করা হয়, মুষলধারে বৃষ্টি এবং বন্যার পর এই রোগটি বিস্তার লাভ করত। সমসাময়িক অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিত ইংল্যান্ডের আর্দ্র জলবায়ুকে দায়ী করতেন এ রোগের জন্য।
ভাইরাসের বাইরে অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিসকেও অনেকে দায়ী করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালে জৈব অস্ত্র হিসেবে অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর ব্যবহারের ফলে প্রায় ২২টি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আক্রান্তের দেহে প্রচুর পরিমাণ ঘাম নির্গত হয়েছে এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথার সূত্রপাত ঘটেছে। এডওয়ার্ড ম্যাক সুইগান নামক এক অণুজীববিজ্ঞানীর মতে, ইংরেজ মুলুকে মহামারির পেছনে ওলের মাধ্যমে ছড়ানো অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর দায়ী থাকতে পারে।
তবে নিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতে পারেনি; সবই ধারণা। এমনকি এই মহামারির কারণ খুঁজতে ২০০২ সালে ইতিহাসবিদরা আর্থারের কবর খুঁড়ে বের করেছিলেন। তবে এরপরও কী থেকে সেই রোগ ছড়িয়েছিল তা বোঝা যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯০৬
আপনার মতামত জানানঃ